Quantcast
Channel: প্রজন্ম ফোরাম - ইতিহাস
Viewing all 121 articles
Browse latest View live

বৃটিশ-বিরোধী লড়াইয়ে বিস্ময়কর দুই মওলানা

$
0
0

বৃটিশ-বিরোধী লড়াইয়ে বিস্ময়কর দুই মওলানা
১।মওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী (১৭০৩-১৭৬২)
২।মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী (১৮৭২-১৯৪৪)

**মওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী (১৭০৩-১৭৬২)

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবকে কার্ল মার্কস ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলেছেন- এ কথা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু অনেকেই জানি না, সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রধান রূপকার ছিলেন সিপাহী বিপ্লবের ১শ' বছরেরও অধিককাল আগে উত্তর ভারতে জন্ম নেওয়া এক ক্ষণজন্ম পুরুষ- মওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী । উপমহাদেশে পরবর্তীকালে স্বাধীনতা আন্দোলনের দুই অগ্রণী নেতা মহাত্মা গান্ধী ও কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যদি হতে পারেন যথাক্রমে ভারত ও পাকিস্তানের ‘জাতির পিতা, তাহলে শাহ ওয়ালীউল্লাহকে বলা যায়— একটি প্রকৃত স্বাধীন ও শ্রেণী:শোষণমুক্ত ভারতবর্ষের প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা।

অথচ আশ্চর্যজনকভাবে বৃটিশ ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের লেখা ইতিহাসে শাহ ওয়ালীউল্লাহর নাম অনেকটাই অনুপস্থিত। থাকলেও তা নিষ্পপ্রভ। দুঃখজনক ব্যাপার হ’ল, বিপুল সংখ্যাগুরু মুসলিম জনগোষ্ঠী আধ্যুষিত দেশ বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা শিক্ষিত লোকদের প্রায় ৭০ ভাগই- বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের অংকুরোদগমে ও তার উত্থানে শাহ ওয়ালীউল্লাহর অবদান সম্পর্কে শুধু অজ্ঞই নন, বরং তাদের অনেকের কাছে শাহ ওয়ালীউল্লাহ মস্ত বড় একজন ‘মৌলবাদী পাণ্ডা’ ছাড়া আর কিছুই নন।

প্রসঙ্গত বলা দরকার, শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী সম্পর্কে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের রাজনৈতিক মহলে রয়েছে দুই ধরনের (পরস্পরবিরোধী) মূল্যায়ন। উপমহাদেশের মুসলিম কমিউনিটির আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে যারা শাহ ওয়ালীউল্লাহকে মূল্যায়ন করেন, তাদের মতে— মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর ভারতবর্ষে ইসলাম যেরকম সঙ্কটাপন্ন পরিস্থিতিতে পতিত হয়েছিল, সেই সঙ্কটের হাত থেকে ইসলামকে রক্ষা করে তাকে নতুন প্ৰাণে উজ্জিবিত করার কাজে মওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।

এদের অনেকের মতে, আঠারো শতকের গোড়ার দিকে সদ্য বৃটিশ-দখলকৃত ভারতে মওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহর মত পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদের আবির্ভাব না হলে, ভারত উপমহাদেশে আজকে হয়তো ইসলামের অস্তিত্বই থাকতো না।

এ প্রসঙ্গে আমাদের কথা হ’ল, উপমহাদেশের মুসলমানরা ইসলাম যতটুকুই বুঝুকি এবং অসংখ্য ধর্মতান্ত্রিক ফেরকা সৃষ্টি করে নিজেদের মধ্যে দলাদলি, এমনকি হানাহানি-রক্তারক্তি করে ইসলামের মূল নীতিকে যতই ভুলুষ্ঠিত করুক- তবুও বর্তমান বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী-ইহুদিবাদী-ব্ৰাহ্মণ্যবাদী শক্তি আজ মধ্যপ্ৰাচ্য ও উপমহাদেশসহ সারা বিশ্বে ইসলামকেই গণ্য করে তাদের প্রধান শত্রু হিসেবে।

সুতরাং উপমহাদেশে ও বাংলাদেশে জালিমদের ঘুম হারাম করে আজও মজলুমের পক্ষ নিয়ে টিকে আছে যেটুকু ইসলাম— তার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে মওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর।

পক্ষান্তরে রাজনীতিক মহলে যারা শাহ ওয়ালীউল্লাহকে নেতিবাদী (নিগেটিভ) দৃষ্টিতে মূল্যায়নের প্রয়াস পান— তাদের মতে শাহ ওয়ালীউল্লাহ একজন ‘ধৰ্মীয় মৌলবাদী’ এবং উপমহাদেশের ‘ইসলামী মৌলবাদের’ প্ৰধান গুরু।

এখানে বলে। রাখা দরকার, বৃটিশ ভারতে মওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে এই প্রচারণাটি প্রথম চালায় ইংরেজরা। পরবতীতে তা সংক্রমিত হয় উপমহাদেশের ব্ৰাহ্মণ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ-প্রভাবিত একশ্রেণীর ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে। ভারত ও বাংলাদেশে শাহ ওয়ালীউল্লাহ-বিরোধী প্রচারণায় এই কথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী গোষ্ঠীটি খুবই সক্রিয়। বলাবাহুল্য এটা শাহ ওয়ালীউল্লাহর প্রতি কোন ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে নয়, এই সক্রিয়তার কারণ তাদের সামাজ্যবাদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদ-প্ৰীতি এবং ইসলাম-বিদ্বেষ।

ইতিহাসে মওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর ভূমিকার যথার্থ মূল্যায়নে যাওয়ার আগে তাঁর মৌলিক রাজনৈতিক দর্শনের ওপর আলোকপাত করা খুবই জরুরী। আমাদের দেশের ইছলামপন্থী রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবীরা শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীকে মূল্যায়নের প্রয়াস পান প্রধানত ধৰ্মতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে, যা শাহ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও কর্মের সামগ্রিক মূল্যায়নের দাবী পূরণ করতে পারে না। গতানুগতিকতার এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে বৃহত্তর পরিসরে শাহ ওয়ালীউল্লাহর যথার্থ মূল্যায়ন আজ সময়ের দাবী বলে আমরা মনে করি।
এ বিষয়ে সকল তর্ক-বিতর্কের উর্ধে থেকে অবলীলাক্রমে যা বলা যায় সেটি হ’ল- রাজনৈতিক চিন্তাধারায় শাহ ওয়ালীউল্লাহ একদিকে ছিলেন এক অখণ্ড, স্বাধীন, ঐক্যবদ্ধ ও সমৃদ্ধশালী হিন্দুস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা। আর অন্যদিকে তিনি ছিলেন  শাসক শ্রেণীর স্বেচ্ছাচারিতা, বিলাসিত, অহমিকা, শক্তির দাপট, সকল প্রকারের শোষণ-লুণ্ঠন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক আপোসহীন জেহাদী।
বলাবাহুল্য শাহ ওয়ালীউল্লাহর আদর্শ ও লক্ষ্যের এই দিকগুলো ইসলামী ঘরানার পণ্ডিত-বুদ্ধিজীবীদের বই-পুস্তক পড়ে পরিষ্কারভাবে জানা যায় না। অন্যদের দারস্থ হতে হয়।
**এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ভারতীয় লেখক-গবেষক সুরজিৎ দাশগুপ্ত তাঁর ‘ভারতবর্ষ ও ইসলাম” গ্রন্থে শাহ ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে বলেছেন---ভারতের “ওয়াহাবী আন্দোলনের’ গুরু  মওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ আসলে ছিলেন মানুষের মধ্যে আদি সাম্যের প্রচারক। ... অর্থনৈতিক বৈষম্যের সমাজে অর্থাৎ যে সমাজ-ব্যবস্থায় জনসাধারণের একটুকরো রুটির জন্য গাধা ও বলদের মত মেহনত করতে হয়, অথচ কিছু লোক না খেটেই সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করে তা উচ্ছেদ করার জন্য ১৭৩১ খৃষ্টাব্দে নাগাদ একটি গোষ্ঠির সৃষ্টি করেছিলেন তিনি।”

মওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহর হাতে গড়া সেই গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে এবং তার ভাবশিষ্য সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীরের নেতৃত্বে বাঙলায়- বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনার পাশাপাশি সমাজে শোষণ-নিপীড়ন ও মানুষে-মানুষে বৈষম্য দূর করার জন্য সামন্তজমিদার-ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে (শ্রেণীশক্ৰদের বিরুদ্ধে) যে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন লড়াই পরিচালিত হয়, সাধারণ প্রচারণায় তার নাম হয় ‘ওয়াহাবী আন্দোলন’।
কিন্তু বেরেলবী ও তিতুমীরের আন্দোলন-লড়াইয়ের তাত্ত্বিক ও আদর্শিক গুরু মওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ আরবের ওয়াহাবী আন্দোলনের ধারক বা অনুসারী ছিলেন না। আঠারো শতকের গোড়াতে আরবে ওয়াহাবী আন্দোলনের সূত্রপাত হয় নজদ অঞ্চলের অধিবাসী আব্দুল ওয়াহাবের নেতৃত্বে। প্রসঙ্গত বলা দরকার আব্দুল ওয়াহাব শাহ ওয়ালীউল্লাহর সমসাময়িক ও সমবয়সী হওয়া সত্ত্বেও এবং শাহ ওয়ালীউল্লাহর একাধিকবার মক্কায় গমনাগমন সত্ত্বেও, আব্দুল ওয়াহাবের সঙ্গে শাহ ওয়ালীউল্লাহর কখনই কোন যোগাযোগ ঘটেনি। শাহ ওয়ালীউল্লাহর জীবনীকার সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভীর দেওয়া তথ্য মোতাবেক আব্দুল ওয়াহাবের সঙ্গে মাওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর কখনও সাক্ষাৎ হওয়া তো দূরের কথা, খোদ একজন সম্পর্কে অন্যজনের জানাশোনা হওয়ারও অদ্যাবধি কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।
বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও গবেষক অধ্যাপক এম. হোসেন, আরবের ওয়াহাবী আন্দোলন থেকে ভারতীয় ওয়াহাবী আন্দোলনের মৌল পার্থক্য নির্ধারণ করেছেন- ১৯৩৯ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেস-এ উপস্থাপিত ‘ওরিজিন্স অব ওয়াহাবিজম’ শীর্ষক এক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধে। এ প্রসঙ্গে সুরজিৎ দাশগুপ্ত অধ্যাপক এম. হোসেনের প্রবন্ধের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন দুটি আন্দোলনের মধ্যে নামের সুস্পষ্ট সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় ওয়াহাবী আন্দোলনের প্রকৃত মন্ত্ৰদাতা আরবের আব্দুল ওয়াহাব নন, দিল্লীর মৌলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ। মওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহর ভাবধারায় সৈয়দ আহমদ বেরেলবী  হজ্জযাত্রার আগেই প্রভাবিত হন। কিন্তু পরে বহির্ভারতীয় জগতেরআন্দোলনে  শামিল করে তোলেন ও ওয়াহাবী নামটি ব্যবহার করতে থাকেন।
এ কারণেই বেরেলবী ও তিতুমীরের নেতৃত্বে পরিচালিত বৃটিশবিরোধী ও সামন্তজমিদারবিরোধী আন্দোলন সাধারণভাবে ‘ওয়াহাবী আন্দোলন” নামে প্রচার লাভ করে। কিন্তু আরবের ওয়াহাবী আন্দোলনের মত ভারতীয় ওয়াহাবী আন্দোলন নিছক ধর্মতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সেটি ছিল শাহ ওয়ালীউল্লাহর রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও আদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত, একইসাথে বৃটিশবিরোধী জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম এবং মানুষে-মানুষে বৈষম্য দূর করে সমাজে ইনছাফ প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রেণীর মুক্তির সংগ্রাম। আর এই প্রেক্ষাপটেই মওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীকে মূল্যায়ন করতে হবে- একদিকে উপমহাদেশে ইছলামের পুনর্জাগরণের অবিসম্বাদিত নেতা হিসেবে, অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম এবং সামন্তজমিদার-ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে শ্রেণীর মুক্তির সংগ্রামের রূপকার হিসেবে। ইতিহাসে শাহ ওয়ালীউল্লাহর ভূমিকার যথার্থ মূল্যায়নের এটাই হচ্ছে সঠিক পন্থা।
২। মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী (১৮৭২-১৯৪৪)
বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের আরেক অবিসম্বাদিত নেতা, কিংবদন্তীতুল্য ব্যক্তিত্ব মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীর নাম ইতিহাসের পাতা থেকে একরকম মুছে ফেলা হয়েছে। প্রকৃত ইতিহাস চেপে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের আজকের তরুণ প্রজন্মের প্রধান করণীয় হ’ল, বৃটিশ ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ষড়যন্ত্রে দু'শ' বছর ধরে চেপে রাখা ইতিহাস পুনরুদ্ধার করে তা জাতির সামনে তুলে ধরা।
ইঙ্গ-ব্ৰাহ্মণ্যবাদী ইতিহাসবিদরা তাদের রচিত— ভারতবর্ষের বৃটিশবিরোধী লড়াইয়ের ইতিহাসে মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীর (সিন্ধু প্রদেশের বাসিন্দা বলে সিন্ধী বলা হয়) যথার্থ স্থান না হলেও ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে হাতেগোণা  যে কয়জন উচ্চতম মর্যাদাসম্পন্ন নেতার নাম প্রকৃত ইতিহাসের পাতায় চিরকাল স্বর্ণীক্ষরে লেখা থাকবে তাদের মধ্যে ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীকে অন্যতম না বলে শ্ৰেষ্ঠতম বিলাই বেহতর।
***অনেকেই জানেন না যে, মওলানা সিন্ধী ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক গুরু এবং মওলানা আবুল কালাম আজাদের আদর্শিক গুরু। তাছাড়া সুভাষ বসুকে জাপানে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী।

**মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী সম্পর্কে গোলাম আহমাদ মোর্তজা লিখেছেন
ইতিহাসখ্যাত হঠাৎ নেতার দলরা স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষে উদিত হয়ে ইংরেজদের সাথে লড়াই না করে হিন্দু-মুসলমানের লড়াই করেছেন, আর শাসক ইংরেজ হাসি চাপা রেখে গভীর মুখে ঐ মারামারিকে স্বাধীনতা যুদ্ধ, আর মোড়লদের যোদ্ধা বলে “টাইটেল’ দিয়েছেন। সুভাষ বসুকে কং দলে গ্রহণ না করার শ্রেষ্ঠ কারণ হচ্ছে এই, তিনি মুসলমানদের আন্দোলনের ফর্মুলা গ্ৰহণ করেছিলেন। আর তাঁর রাজনৈতিক গুরু ছিলেন মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী। বৃটিশ সরকার যখন বুঝতে পারল যে উনি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ যেখানে থাকবেন সেখানেই বিপ্লবের আগুন জ্বলে উঠবে- তখন তাঁর ওপর আইনের আদেশ চাপানো হলো যে, তাকে চিরদিন ভারতবর্ষে প্রবেশ করা চলবে না। বাধ্য হয়েই তাকে ভারতবর্ষ ছেড়ে যেতে হয়। কিন্তু ইংরেজ যদি- ভারতের বাইরে তিনি কতটা সংগঠন ও বিপ্লবীদের সাহায্য এবং ভারত ত্যাগী মুজাহিদদের পথ চলার পাথেয় পরিবেশনা করতে করতে পারেন চিন্তা করত ,তবে তাকে ভারতেই আটকে রেখে বরং বহিভারতে যাতায়াত বন্ধ করে দিত।” **জনাব মোর্তজা অতঃপর লিখেছেন--
মওলানা উবাইদুল্লাহ বৃদ্ধ বয়সে দেশে আসার অনুমতি পান। প্রথমেই তিনি আসেন ভারতের মস্তক বঙ্গে- কলকাতায় । ওখানে আলেমদের জমিয়তে উলামায়ের অধিবেশন। নেতাজী সুভাষ বসু আগে হতেই তাঁর যোগ্যতা, দৃঢ়তা ও ভারতপ্রেমের কথা জানতেন, কিন্তু শিষ্য হওয়ার মতো, বিশেষভাবে পরামর্শ করার মতো সুযোগ পাননি। সুভাষ এবার মওলানার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন, তার পরামর্শ চাইলেন এবং তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে চাইলেন। তিনি (সুভাষ) জানালেন, ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতায় তিনি বিশ্বাসী এবং ভারতের জন্য জীবন দিতে তিনিও প্ৰস্তুত।
মওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী তাঁকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন এবং আস্তে আস্তে বললেন, “আজ রাত্ৰে তৈয়ব ভাই জরিফের বাড়ীতে গোপন আলোচনা হবে । রাত্ৰিতে গোপন কথা হয়েছিল। সেখানে ছিলেন চৌধুরী আশরাফুদ্দিন আর বর্ধমানের মাওলানা আবুল হায়াত প্রমুখ বিখ্যাত প্রকৃত নেতা।
ওখানে উবাইদুল্লাহ সিন্ধী সুভাষ বসুকে আদেশ করেন, “অত্যন্ত চুপিচুপি তুমি **মাওলানা জিয়াউদ্দীন **নাম নিয়ে ১৭ জানুয়ারী (১৯৪১) রওনা হও”।
তারপর মওলানা উবাইদুল্লাহ সাহেব নিজের হাতে অনেক চিঠিপত্র লিখে দিলেন এবং জানালেন, কোন জায়গায়, কোথায়, কী নামে, কী বেশে, কী পদে, কোন রাষ্ট্রে তার শিষ্য-ভক্ত কমীরা আছেন। হয়েছিলও তাই।”


বাস্তবেও দেখা যায়, সুভাষ বসু তাঁর গুরু, মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীর একান্ত অনুগত শিষ্য হিসেবে ভারতের মুসলিম বিপ্লবীদের মতো ইংরেজদের বিরুদ্ধে পূর্ণ স্বাধীনতার লড়াইকেই আমৃত্যু অনুসরণ করেছেন। দেখা যায়, সুভাষ বসুর আযাদ-হিন্দ ফৌজের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের অধিকাংশই ছিলেন মুসলমান। যেমন ক্যাপ্টেন শাহনাওয়াজ, ক্যাপ্টেন বুরহানুদ্দিন, ক্যাপ্টেন আবদুর রশীদ এবং জমাদার ফতেহ খান প্রমুখ।

মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতার লড়াইয়ে তাঁর পরিকল্পনা ও প্রস্তাব সুভাষ বসুকেও দিয়েছিলেন, কংগ্রেসকেও দিয়েছিলেন। কংগ্রেস নেতা গান্ধীজি তা অস্বীকার করেছিলেন, আর সুভাষ বসু মৃত্যু পর্যন্ত তা পালন করেছিলেন। ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠতম বিপ্লবী অশীতিপর বৃদ্ধ এই মওলানাকে বৃটিশরা গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায় এবং সেখানেই কাপুরুষোচিতভাবে বিষপ্রয়োগে তাঁকে হত্যা করে। এটি ছিল বিশ্বের ইতিহাসে নিকৃষ্টতম কাপুরুষোচিত হত্যাকাণ্ডের একটি।

নেতাজি সুভাষ বসুর ওপর মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীর প্রভাবের বিষয়ে এবং বিপ্লবী ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী সম্পর্কে মওলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু মওলানা জহীরুল হককে যে পত্র লিখেছিলেন তার বাঙলা তর্জমার কিছু অংশ গোলাম আহমাদ মোর্তজার ‘ইতিহাসের ইতিহাস’ গ্রন্থের বরাতে এখানে তুলে ধরা হ’ল-
দিল্লি ১৫ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭
স্নেহের মৌলুবী জহীরুল হক (দ্বানপুরী) আছছালামুআলাইকুম আ রহমতুল্লাহ আযাদী উপলক্ষে আপনার প্রেরিত পত্রের জন্য শুভেচ্ছা জানাই। পত্র পড়ে স্মৃতিপটে ভাসে শুধুই মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধীর (র.) স্মৃতি। সেই ঘটনা অনেক লম্বা, সংক্ষেপ করলেও যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। ১৯১৪ সালে বিশ্বযুদ্ধের সময় শাহ ওয়ালীউল্লাহর (র.) কাফেলার নেতা। হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান (র.) অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধীকে কাবুল প্রেরণ করেন। সেখানে মাওলানা উবাইদুল্লাহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করেন। তন্মধ্যে জার্মান, ফ্রান্স ও জাপানের এমন সব নেতা-কর্মী ছিলেন, যারা পরবর্তীকালে শাসনক্ষমতার উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
পচিশ বছর নির্বাসন ভোগ করে ১৯৩৯ সালে তিনি যখন দেশে আসেন। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তিনি তাঁর নিজস্ব পরিকল্পনা কংগ্রেসের কাছে পেশ করে সর্বভারতীয় সংগ্রামের প্রোগ্রাম রচনা করেন, সেই সময় গান্ধীজি পর্যন্ত ঐ পরিকল্পনার বিরোধিতা করেন। তাহলেও “ভারত ছাড়’ আন্দোলনটুকু অনুমোদন লাভ করে। একদিন চায়ের মজলিশে তাঁর (উবাইদুল্লাহ সিন্ধীর) সঙ্গে আমার আলাপ হয়। তাঁর চোখ ও চেহারায় চিন্তার চিহ্ন দেখে আমার মনে অনুসন্ধিৎসুর প্রশ্ন জাগে। আমি প্রশ্ন করতেই কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে তিনি তাঁর বাসা উখলায় ফিরে যান।
>>দ্বিতীয় দফায় উখলা হতে দিল্লি পর্যন্ত আট মাইল সড়কের কোন একটি জনমানবশূন্য স্থানে তাঁর সঙ্গে সুভাষের সাক্ষাৎ সংঘটিত হয়। তার পরের সাক্ষাৎটি হয়েছিল কলকাতার বালিগঞ্জ এলাকায়। এইখানে তিনি সুভাষকে জাপান যাত্রার জন্য রওনা করান। জাপান সরকারের নামে একটি ব্যক্তিগত বিশেষ বার্তাও পাঠান। তাই সুভাষ সেখানে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে জাপান সরকারের সৈন্য বিভাগও তাঁর প্রতি আস্থা স্থাপন করতে পেরেছিল।<<
শেষ পর্যন্ত ভয়ংকর বিষ প্রয়োগ করে মাওলানা সাহেবের জীবন শেষ করা হয়। ১৯৪৪ সালের ২২শে আগস্ট তিনি মহামিলনে শামিল হলেন মহান মাওলা স্রষ্টার সঙ্গে। সেদিন আকাশ হতে অশ্রু ঝরেছিল। সারা পৃথিবী শোকে মুহ্যমান হয়েছিল। ভারত সরকার এ সংবাদ গোপন রেখেছিল। ...
অবশেষে সাধারণের ধারণা সত্য বলে প্রমাণিত হয়। ১৯৪৫ সালে পুরো একবছর নয়দিন পর সরকারীভাবে স্বীকার করা হয় মাওলানা সাহেব নিহত হয়েছেন। বাস্তবিক এমন একজন বিপ্লবীকে ওজনের তুলাদণ্ডে এক পাল্লায় রেখে অন্য পাল্লায় সারা পৃথিবী চাপালেও এই বিপ্লবীর সমান হয় না। এখন রয়ে গেছে তাঁর অপরূপ স্মৃতি ও অপূর্ব বিরহ-বেদনা। দুঃখ শুধু এজন্য নয়। যে, তিনি চলে গেছেন। এজন্য দুঃখ যে, তিনি এ জগতের মানুষ ছিলেন তা আজ প্রায় অবলুপ্ত। আমরা সেই দলেরই পশ্চাৎবতীর্ণ কমী, সেই কাফেলার অনুরূপ দল আর পাইনা, আর পাচ্ছিনা গন্তব্যস্থলের ঠিকানা। আমাদের কেউ চিনে না, আর অন্যদেরও আমরা চিনতে পারছি না। সেই শহীদদের উপর স্বাধীনতার গৌরব অৰ্পিত হউক ।
আলহামদুলিল্লাহ (আল্লাহর প্রশংসা)। আমি সুস্থই আছি। আপনার কুশল জানাবেন। আপনার সম্মানিয়া মাতার প্রতি রইলো আন্তরিক সালাম ।
ইতি
   আবুল কালাম *


এই পত্রের মাধ্যমে পরিষ্কার বোঝা যায়- মওলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর মতাদর্শিক গুরু মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীর প্রতি এতটাই গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করেছেন এবং তাকে এমন উচ্চতম মর্যাদার আসনে স্থান দিয়েছেন, যা তিনি তাঁর রাজনৈতিক গুরু মহার্তা গান্ধীকেও কখনও দেননি।
**ভারত ও বাংলাদেশের কথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এবং মৌলানা আবুল কালাম আজাদের প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন করেন। খুবই একপেশে দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে। সুভাষ বসুর প্রতি তাঁরা শ্রদ্ধাপ্রদর্শন করেন। একজন ‘বামপন্থী সমাজতন্ত্রী সুভাষ বসু হিসেবে। আর মৌলানা আবুল কালাম আজাদের প্রতি তারা শ্রদ্ধাপ্রদর্শন করেন। শুধু গান্ধীর ভাবশিষ্য ও কংগ্রেস নেতা হিসেবে। মওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধীর সাথে সুভাষ বসু ও আবুল কালাম আজাদের ঘনিষ্ঠ গুরু-শিষ্য সম্পর্কের কথা কথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা কখনই মুখে আনেন না। কারণ ওর মধ্যে তারা ‘মৌলবাদের’ গন্ধ পান। দুঃখজনক ব্যাপার হ’ল, স্বাধীনতার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ আত্মোৎসর্গকারী এবং সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী মহান বিপ্লবী উবাইদুল্লাহ সিন্ধীর নাম বৃটিশ ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের চক্রান্তে ইতিহাসের পাতায় প্রায় অনুপস্থিত। বাংলাদেশ ও উপমহাদেশের মুসলমানদের বহু গৌরবময় ইতিহাস এইভাবেই ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে।
**বইঃ আত্মবিস্মৃত বাঙালী – ইঙ্গ- ব্রাক্ষণ্যবাদ ও বাঙালীর ভাগ্য বিপর্যয়ের পর্যালচনা
**লেখকঃ রইসউদ্দিন আরিফ


ঢাকার ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডী HQ পিডিএফ

$
0
0

বইঃ ঢাকার ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডী HQ পিডিএফ
লেখকঃ আনিস সিদ্দিকি
প্রকাশনীঃ নওরোজ সাহিত্য সম্ভার
দামঃ৮০(৬০) টাকা
লিংকঃ https://www.pdf-archive.com/2017/06/20/ … k-tragedy/
ধন্যবাদঃ কাজী মাহমুদুল হক
------সব্বাইকে ঈদ শুভেচ্ছা।

সুর্য তখন ডুবে গেছে। পশ্চিমাঞ্চলে। মাগরিবের নামাজে দাঁড়িয়েছেন  বাবা আদম । এমন সময় বিজয়ী বেশে উন্মুক্ত তরবারি হাতে সেখানে হাজির হলেন স্বয়ং রাজা বল্লাল সেন। দেরী সহ্য হলো না তার। প্রচন্ড আঘাত হানলেন দরবেশের মাথায়। কিন্তু ফল হলো না কিছুই। পাগড়ির ঝুলন্ত অংশ পর্যন্ত রইলো অক্ষত | অবাক হলেন বল্লাল সেন। তরবারি উত্তোলন করলেন আবার । এই সময় নামাজ শেষ হলো বাবা আদমের। সালাম ফিরায়ে আরম্ভ করলেন দীর্ঘ মোনাজাত। মোনাজাত শেষে অনেক কথা কাটাকাটি হলো রাজার সাথে। পরিশেষে তিনি বললেন,-খোদার ইচ্ছায় বিধমীর হাতেই মুহুর্তে মৃত্যু হবে আমার। কিন্তু তোমার তরবারিতে নয়। এই নাও আমার তরবারি। আঘাত হানো। এবার ঠিক কামিয়াব হবে। তবে তুমি বাচতে পারবে না। খোদার অভিশাপ নেমে আসবে তোমার উপরে । তোমার পাপে অনেক নিরীহ ব্যক্তি হয়তো প্ৰাণ হারাবে। দম্ভকে খোদা সহ্য করেনা। নিজের ভালো তুমি বুঝলে না। জয়নামাজের নীচ থেকে তরবারিটা বের করে দিলেন বাবা আদম । বললেন,- এবার আঘাত হানো । আদমের মাথার উপর উত্তোলন করে বললেন,-এতোদিন অনর্থক ভয় করতাম মুসলিম শক্তিকে। অনেক রাজা মোকাবেলা করতে সাহস পাননি মুসলমানদের। কিন্তু আমি দেখলাম, কিছুই না। সাহস করলে, বীরের মতো যুদ্ধ করতে পারলে মুসলমানদের পরাজিত করা কঠিন কিছু নয়। —রাজা, ভুল করছো। আমরা যোদ্ধা নই। ধর্ম প্রচারক। মুসলিম সৈনিকদের সাথে শক্তি পরীক্ষার সুযোগ তোমার জীবনে হবে না। তার আগেই খোদার অভিশাপ নেমে আসবে তোমার পরিবারে। নির্বংশ হবে তুমি। দরবেশের কথা শেষ হতে পারলো না। দাঁড়িয়ে অভিশাপ শোনার ধৈর্য তার ছিল না। দরবেশের তরবারি দিয়েই আঘাত হানলেন তিনি দরবেশের কাধে । এবার সহজে তিনি দূরে। এই সময় কোন ফাঁকে তার জামার নীচ থেকে পায়রা বেরিয়ে গিয়েছিল, জানতে পারেননি। তিনি। বিজয়ের আনন্দে তখন তিনি আত্মহারা । আত্মীয়বর্গ তখন প্রাসাদের ছাদে দাড়িয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন দিনশেষে যুদ্ধের খবর শোনার জন্য। সেদিন কোনো দূত যায়নি। পতপত করে হাজির হয়েছিল বল্লাল সেনের নিয়ে যাওয়া সেই বিশেষ পায়রাটা। পায়রা জানতো না, কতো মারাত্মক পরিণতির ভয়াবহ সংবাদ সে পৌঁছে দিয়েছিল প্ৰাসাদের অধিবাসীদের কাছে। মুহুর্তে মৰ্মভেদী কান্নার রোল উঠলো সমগ্র রাজপ্রাসাদে। বিলাপ করার সময় ছিল না তাদের হাতে। অগ্নিকুণ্ডে শুকনো কাঠ সরবারহ করা হলো। বেশি পরিমাণে ঢেলে দেওয়া হলো কয়েক টিন ঘি। বিজয় উন্মত্ত মুসলিম সেনারা অচিরেই পৌছে যাবে প্রাসাদে।

এই রকম নানা ঐতিহাসিক কাহিনীর বর্ননা আছে এই বই এ-----
জানতে হলে পড়তে হবে এই বই।
ধন্যবাদ, রোজার সামনের দিন গুলি  কেটে যাবে আনন্দে।

বাংলার কিংবদন্তি কালাপাহাড় – ও মন্দির ভাঙার গল্প ।

$
0
0

বাংলার কিংবদন্তি কালাপাহাড় – ও মন্দির ভাঙার গল্প ।
সুলেমান কররানী বাঙলার সুলতান হয়েছেন ১৫৬৫ সালে। সুলতান একদিন উজিরকে ডাকলেন।
বললেন-কাকে রাজধানীর ফৌজদার করা যায় ?
উজির যার নাম করলেন সুলতান তাকে পছন্দ করলেন না। বললেন - যুদ্ধে উনি সকলের আগে পালিয়ে যান। অমন মানুষকে আমি গৌড়ের ফৌজদার করতে পারি না।
উজির এবার আরেক জনের নাম মনে করে সুলতানকে বললেন---সুলতান আপনার নয়ান রায়ের কথা মনে আছে ?
কিন্তু নয়ান রায় মারা গেছেন সুলতান বললেন । শুনেছি তার একজন যোগ্য পুত্ৰ আছে।
সেই পুত্রের কথা আপনি জানেন ?
দরবারে একজন মৌলবি ছিলেন। তিনি সুলতানকে কুর্নিশ করে বললেন-নয়ান রায়ের পুত্ৰ কালাচাঁদ রায় আমার কাছে ফারসি শিক্ষা নিয়েছে। তার ডাকা নাম রাজু । মস্ত বীর, আর তার মত তীরন্দাজ সচরাচর দেখা যায় না।
সুলতান খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলেন-তার স্বভাব-চরিত্র কেমন ?
মৌলবি সাহেব বললেন-বাপক বেটা, কালাচাঁদ নেমকহারামি জানে না। খুব ধাৰ্মিক।
সুলতান তখন উজিরকে বললেন-এই কালাচাঁদকেই রাজধানীর ফৌজদার করব ভেবেছি।
আপনি কী বলেন ?
উজির সসম্ভ্রমে বললেন-শাহানশাহ ঠিক মানুষটিকেই বেছে নিয়েছেন। কালাচাঁদ অবশ্যই রাজধানীর ফৌজদার হওয়ার যোগ্য।
সুলতান বললেন -তবে আর দেরি কেন । আমার জরুরি পরোয়ানা দিয়ে এখনই কালাচাঁদের কাছে সাওয়ার পাঠিয়ে দিন।
জরুরি পরোয়ানা নিয়ে সওয়ার ছুটিল বীরজওনের দিকে। বীরজাওনা গ্রামে কালাচাঁদের বাড়ি ।
স্বয়ং বাদশাহের জরুরি পরোয়ানা । কালাচাঁদ মাকে বললেন মা, বাদশাহ আমাকে গৌড়ে ডেকে পাঠিয়েছেন।
মা বললেন-বাছা, বাদশাহের হুকুম এসেছে যখন, যেতেই হবে।
মায়ের পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে কালাচাঁদ চললেন গৌড়ের দিকে ।
সময় মতো হাজির হলেন বাদশাহের দরবারে । কালাচান্দকে দেখেই সন্তুষ্ট হলেন বাদশাহ।
যেমন শুনেছিলেন। তেমনি দেখলেন। বাদশাহ বললেন-তোমাকে কেন ডেকে এনেছি জানো ?
কালাচাদি কিছুই জানেন না । হুকুম পেয়ে ছুটে এসেছেন দরবারে । বাদশাহ বললেন-আজ থেকে তুমি গৌড়ের ফৌজদার।
উজিারের কাছ থেকে তোমার কাজ বুঝে নাও ।
কালাচাঁদ গৌড়ের ফৌজদার হলেন। গৌড়ের ফৌজদার হওয়া সোজা কথা নয়।
রাজপ্রাসাদের কাছেই ফৌজদারের আস্তান। অদূরে নদী । প্রত্যহ সকালে নদীতে স্নান করতে যান কালাচাঁদ। স্নান সেরে হাটা পথে গঙ্গাস্তব করতে করতে ফিরে আসেন নিজের আস্তানায় । হাতে থাকে সোনার কোশ, সঙ্গে থাকে ছাতাবরাদার। তখন কালাচাদের পরনে থাকে দামি গরদ । চমৎকার ফরসা চেহারা, মাথায় ঘন চুল, গলায় ধবধবে পৈতে-লোকে মুগ্ধ হয়ে কালাচাঁদকে দেখে, মুগ্ধ হয়ে শোনে কালাচাঁদের মুখের সুন্দৰ গঙ্গাস্তব । পুজো সেরে দরবারী পোশাক পরে দরবারে যান। সে সময়ে আগে বীরকন্দাজ, মধ্যিখানে ঘোড়ায় বা পালকিতে ফৌজদার কালাচাঁদ রায়, পিছনে ঘোড়সওয়ার সৈন্য ।
দিনের পার দিন যায়।
কালাচাঁদের প্রশংসায় সকলেই পঞ্চমুখ । রাজপ্ৰাসাদ থেকে বাদশাহের মেয়ে দুলালী দিনের পর দিন দেখেছেন কালাচাঁদকে। দিনের পর দিন দেখে-দেখে দুলালী মনে মনে ঠিক করে ফেলেছেন যে এই কালাচাঁদ রায়ই তার বর হবেন । রূপকথার কোনো কোনো রাজকন্যা যেমন নিজের বর নিজেই মনে মনে ঠিক করে রাখে ।
দুলালীর মনের কথা জানতে বাকি রইল না বেগমসাহেবার। আর ৰেগমসাহেবার মুখ থেকে শুনলেন বাদশাহ সুলেমান কররানী !
একদিন বাদশাহ নির্জনে ডেকে আনলেন কালাচাঁদকে । বললেন তুমি শাহজাদী দুলালীর কথা জানো ?
নাম শুনেছি।
কখনও চোখে দেখিনি ।
বাদশাহ বললেন-আমার আদেশ, তুমি শাহজাদীকে বিবাহ কর ।
কালাচাঁদ কুর্নিশ করে বললেন-জাহাপনা, আমি কেমন করে শাহজাদীকে বিবাহ করব ?
আমি শাহজাদীকে বিবাহ করলে আমার জাত যাবে। আমি হিন্দু ব্ৰাহ্মণ ।
বাদশাহ বললেন-আমি তো তোমাকে মুসলমান হতে বলিনি।
তুমি যেমন আছ তেমনি থেকে শাহজাদীকে বিবাহ করো।
কালাচাঁদ বললেন--হিন্দুসমাজ তা মানবে ?
অসম্ভব। আমার জাত যাবে, ধর্ম যাবে ।
বাদশাহ রাগে অস্থির হয়ে উঠলেন । বললেন-কালাচাঁদ জানো আমি কে ?
কালাচাঁদ বিনয় করে বললেন-জানি । হুজুর বাঙলার বাদশাহ, অধীনের জানপ্ৰাণের মালিক।
বাদশাহ বললেন - আমার আদেশ অমান্য করলে তোমার প্রাণদন্ড হবে ।
বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে কালাচাঁদ বললেন-প্ৰাণ যায় যাক।
কিন্তু আমার জাত থাক, আমার ধর্ম থাক ।
বাদশাহের হুকুমে বন্দী করা হল কালাচাঁদকে। বাদশাহের হুকুম -কাল কালাচাঁদের প্রাণদণ্ড ।
পরদিন সকালে বধ্যভূমিতে নিয়ে আসা হল কালাচাঁদকে। শেযমুহুর্তের আর বুঝি বাকি নেই।
কিন্তু এ কী আশ্চৰ্য কাণ্ড, পাগলের মতো ছুটতে-ছুটতে সেখানে এসে উপস্থিত দুলালী ৷
কী রূপ । যারা চিনত না তাবা ভাবল কে এই স্বর্গের দেবী ?
যারা চিনত তারা চিৎকার করে উঠল-শাহজাদী, শাহজাদী।
দুলালী নিৰ্ভয়ে বললেন - আমার প্রাণ থাকতে কেউ ফৌজদারের গায়ে হাত দিতে পারবে না।
আগে আমাকে মেরে তারপর ফৌজদারকে মারতে হবে।
কালাচাঁদ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন দুলালীর মুখের দিকে। তাকে বাঁচানোর জন্য নিজের প্রাণ যে বলি দিতে রাজি সে তো সামান্য মেয়ে নয়। চোখের পলকে কালাচাদের মন আরেক রকম হয়ে গেল । এই মেয়েকে বিবাহ করলে জাত যাবে, ধর্ম যাবে ?
বরং কালাচাঁদের মনে হল এই মেয়েকে বিবাহ না করলে জাত থাকবে না, ধর্ম থাকবে না।
খবর পেয়ে সুলেমান কররানী ছুটে এলেন তরবারি হাতে নিয়ে।
কিন্তু কালচাদ তখন নিৰ্ভয়  বললেন-বাদশাহ, এই শাহজাদী আমার ধর্মপত্নী ।
বিবাহের পর কালাচাঁদ আর ফৌজদার রইলেন না, সেনাপতি হলেন ।
সেনাপতির নতুন আস্তানা । দুলালীকে নিয়ে কালাচাঁদ নতুন আস্তানার বাসিন্দা হলেন ।
কালাচাঁদ বাদশাহের জামাতা  হয়েছেন, সেনাপতি হয়েছেন ; কিন্তু নিজের ধর্মকর্ম ছাড়েননি। আগের মতোই তিনি প্ৰত্যহ সকালে নদীতে স্নান করতে যান, স্নান সেরে হাঁটাপথে গঙ্গাস্তব করতে করতে ফিরে আসেন নিজের আস্তানায়, হাতে থাকে সোনার কোশ, পরনে থাকে দামী গরদ, গলায় ধবধবে পৈতে ।
কিন্তু বীরজাওনে রটে গেছে যে গ্রামের ছেলে কালাচাদ শাহজাদীকে বিবাহ করে মুসলমান হয়েছেন। গ্রামের পণ্ডিতেরা একঘরে করে দিলেন তাকে ।
কালাচাঁদের মা উত্যক্ত হয়ে বললেন-কালাচাঁদ মন্দ কাজ করতে পারে না। সে যদি ভালো বুঝে বাদশাহের মেয়েকে বিয়ে করে থাকে তো বেশ করেছে। তা নিয়ে লোকজনের এত মাথাব্যথা কেন ?
বীরজওন থেকে খবর গেল যে মা কালাচান্দকে বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছে। কালাচাঁদ খবর পেল যে মা তঁর উপর অসন্তুষ্ট হননি ; তার উপর মায়ের আস্থা অটুট আছে।
কালাচাঁদ সাব্যস্ত করলেন এবাব বীরজওনে তিনি দুলালীকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন না ।
দুলালী আপত্তি করে বললেন-আমি মাকে দেখতে যাব না ? ?
কালাচাঁদ বললেন-এবার আমি একাই যাই। সময় হলে তোমাকে নিয়ে যাব।
বীরজওনে এসে কালাচাদ জানলেন যে গ্রামে তিনি একঘরে । কিন্তু মা সব শুনে অভয় দিয়ে বললেন- তুমি মানুষের মতে কাজ করেছ। এমন মেয়েকে বিবাহ না করলে তোমার অধৰ্ম হত । ভালো কাজ করলে কি কারও জাতধর্ম যায় ? যায় না। তবে পণ্ডিতদের জানো তো, তঁদের চক্রান্তে হয়তো তোমাকে কিছু দুঃখকষ্ট পেতে হবে ।
যে যাই বলুক, পণ্ডিতদের চক্রান্তে একঘরে হয়ে রইলেন কালাচাঁদ । একঘরে থাকলে লাঞ্ছনা-অপমানের জ্বালা দুঃসহ হয়ে উঠে।
অপরাধ না করেও কি তঁকে চিরদিন একঘরে হয়ে থাকতে হবে ? পণ্ডিতেরা বিধান দিলেন-পুরীর জগন্নাথদেব যদি আদেশ দেন তো কালচাদকে আর একঘরে হয়ে থাকতে হবে না ।
কালাচাঁদ চলে এলেন পুৱীতে। কিন্তু পণ্ডিতদের ষড়যন্ত্রের ফলে পাণ্ডাদের কাছে তিনি অপরাধী হয়ে আছেন। পাণ্ডারা তাকে মন্দিরে ঢুকতে দিল না।
কালাচাদি অগত্যা মন্দিরের বাইরে জগন্নাথের কাছে ধরনা দিলেন। প্রার্থনা করলেন-প্ৰভু, তুমি অন্তৰ্যামী, তুমি সব জানো। পণ্ডিতেরা আমাকে বিনাদোষে একঘরে করেছে, লাঞ্ছনা-অপমানের জ্বালা আমার আর সহ্য হচ্ছে না।
শুনেছি, তুমি অগতির গতি, তোমার কাছে সকলে সমান। তুমি আমাকে উদ্ধার করে।
মন্দিরের বাইরে চোখ বুজে কালাচাঁদ অনাহারে সাতদিন ধরন দিয়ে রইলেন। কিন্তু কোনো দৈব আদেশ পেলেন না। সাতদিন পায় উঠে বসলেন। রাগে ও অপমানে তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন । মন্দিরের দিকে তাকিয়ে জগন্নাথকে বললেন-
“তুমি দেবতা নও, যদি দেবতা হতে তো বিনাদোষে আমাকে লাঞ্ছনা-অপমানের জ্বালা সইতে হত না, তোমার দরজায় সাতদিন আমাকে অনাহারে ধরন দিয়ে থাকতে দিতে না। তুমি কাঠের পুতুল, আর কিছু নও। আমার প্ৰতিজ্ঞা-মন্দিরে-মন্দিরে তোমার মতো কাঠ, মাটি ও পাথরের যত মূৰ্তি আছে, সব আমি নিশ্চিহ্ন করে ছাড়ব।“
কালাচাঁদ তখন রুদ্রমূর্তি। ফিরে এলেন রাজধানীতে। আর হিন্দু রইলেন না, মুসলমান ধর্মে দীক্ষা নিলেন। নতুন নাম হল - কালাপাহাড় ।
সুলেমান কররানীর আদেশ নিয়ে বিস্তর সৈন্যসমেত কালাপাহাড় চললেন উড়িষ্যার দিকে। পথে তমলুকে বর্গভীমাদেবীর বিখ্যাত মন্দির। বর্গভীমাদেবীর মূর্তি দেখে কালাপাহাড়, কেন কে জানে, মুগ্ধ হয়েছেন। তিনি এই দেবীমূর্তি ও মন্দিরের তিলমাত্র ক্ষতি করেননি।
**বরং ফারসিতে একখানা দলিল লিখে দিয়ে গেছেন। দলিলখানা শোনা যায়, এখনও আছে বর্গভীমাদেবীর পূজারীদের কাছে। এই দলিলখানার নাম-বাদশাহী পাঞ্জা।**
কালাপাহাড়ের কাহিনীতে বর্গভীমাদেবীর অধ্যায় আজও পরম বিস্ময় হয়ে আছে।
কালাপাহাড় পুরীর মন্দির লুণ্ঠন করলেন ১৫৬৮ সালে। পাণ্ডারা জগন্নাথদেবের মূর্তি নিয়ে চিল্কা হ্রদের কাছে পারিকুদে একটি গর্তের মধ্যে লুকিয়ে রাখল। খবর গোপন রইল না। কালাপাহাড়ের কাছে। গর্ত থেকে সেই মূৰ্তি বের করে কালাপাহাড় টেনে নিয়ে এলেন, আগুনে পুড়িয়ে জলে ফেলে দিলেন।
পুবে আসাম, পশ্চিমে কাশী ও দক্ষিণে উড়িষ্যায় বিস্তর বিখ্যাত মন্দির; কালাপাহাড় কোনো-কোনো মন্দিরের অংশবিশেষ ধ্বংস করেছেন, কোনো-কোনো মন্দির পুরোপুরি ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন।
কালাপাহাড়ের কাড়ানাকড়া বাজলে, লোকে বলে, সকল দেবমূর্তি কম্পিত হত। কালাপাহাড় সর্বনাশী নৃশংস অত্যাচারী।
১৫৭২ সালে সুলেমান কররানীর মৃত্যু হয়েছে। তারপর তঁর জ্যেষ্ঠপুত্র কয়েজিদ সিংহাসনে আরোহণ করেছেন। অল্পকাল পর তিনি নিহত হয়েছেন।
তারপর সুলতান হয়েছেন তার কনিষ্ঠ ভ্রাতা দায়ুদ কররানী। কালাপাহাড়, বলে রাখা ভালো, দায়ুদ কররানীর সেনাপতি। ইতিহাসে পাওয়া যায় মোগল সৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধে কালাপাহাড় নিহত হয়েছেন।
কিন্তু লোকে সেকথা মানে না। কালাপাহাড় জগন্নাথদেবের মূর্তি আগুনে পুড়িয়ে জলে ফেলে দিয়েছেন, মনে আছে ? সেই পাপে, লোকে বলে, কালাপাহাড়ের হাত-পা খসে গেছে-কালাপাহাড়
মরেছেন ।

@বাবা আদমের অভিশাপ ও রাজা বল্লাল সেন@

$
0
0

@বাবা আদমের অভিশাপ ও রাজা বল্লাল সেন@ 

পিতার মৃত্যুর পর ১১৫৮ সালে বল্লাল সেন আরোহণ করেন বাংলার সিংহাসনে। তিনি ছিলেন গোড়া হিন্দু। ধর্মের মধ্যে ব্ৰাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য প্রভৃতি কৌলিন্যের প্রথা বাংলাদেশে তিনিই প্রবর্তন করেন প্রথম। তার শাষন আমলে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব বিনষ্ট হয় । সমগ্ৰ অঞ্চল থেকে ক্ৰমান্বয়ে বিলুপ্তি ঘটে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের। এই অঞ্চল যে এক সময বৌদ্ধ শাসন ছিল; জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, সাহিত্যে তারা অনেক উৎকর্ষ লাভ করেছিল আজকের বিক্রমপুর দেখলে তা অনুধাবন করা যায় না। বল্লাল সেনের সক্রিয় সমর্থনে এবং সহযোগিতায় পূর্ণজাগরণ ঘটেছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। আর সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্তি ঘটেছিল বৌদ্ধদের। শুধু বঙ্গদেশে নয়, নেপাল ভুটান, আরাকান ও ব্ৰহ্মদেশে তিনি হিন্দুধর্ম প্রচারের ব্যবস্থা করেন। সে সব দেশের হিন্দু অধিবাসীদের মধ্যে অধিকাংশই বল্লাল সেনের হিন্দু ধর্ম প্রচারের সক্রিয় সহযোগিতার ফল। তিনি নিজে যেমন ছিলেন বীর, তেমনি ছিলেন বিদ্বান। ‘দান সাগর” ও “অদ্ভুত সাগর’ নামে রচিত সংস্কৃত গ্রন্থদ্বয় তার গভীর পান্ডিত্যের পরিচায়ক।
শোনা যায়, ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। কিংবদন্তি অনুযায়ী তার মাতার উপর বিরাগ হয়ে তার পিতা গৰ্ভবতী রানীকে প্রাসাদ থেকে বিতড়িত করেন। সাতরিয়ে কিংবা অন্য কোনোভাবে রানী নদী অতিক্রম করে আশ্ৰয় নেন এপারের গভীর জঙ্গলে । সেখানেই জন্ম হয় বল্লাল সেনের। কালে কালে প্রাকৃতিক নিয়মে বর্ধিত হয় তার বয়সী। নিষ্ঠার সাথে নানা বিদ্যা আয়ত্তে মনোনিবেশে করেন। তিনি। খ্যাতিলাভ করেন যৌবনে । তার যশাগাথা কানে যায় তার পিতার। কৃতী পুত্ৰকে দেখতে আগ্রহ জাগে রাজার মনে। বল্লাল সেনকে যখন তার পিতার সামনে হাজির করা হয় তখন তিনি সুদৰ্শন পুত্রের সৌম্য চেহারা ও বলিষ্ঠ দেহ দেখে হন মুগ্ধ। পিতৃস্নেহে আলিঙ্গণ করেন তাকে। রাজ্যের উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন আজন্ম অবহেলিত বুদ্ধিদীপ্ত পুত্ৰ বল্লাল সেনকে।
পরবর্তীকালে রাজা হয়ে বল্লাল সেন তার শৈশব-যৌবনের লীলাক্ষেত্রে এক মন্দির প্ৰতিষ্ঠা করেন। তার নাম দেওয়া হয় ঢাকেশ্বরী মন্দির। অনেকের মতে শৈশবে খেলা করার সময় ওই স্থানে তিনি একটা দুৰ্গা মূর্তি ঢাকা অবস্থায় পেয়েছিলেন। সেজন্য মন্দিরটির নাম দিয়েছিলেন ঢাকা-ঈশ্বরী’ অর্থাৎ “লুক্কায়িত দেবী মন্দির। আবার অনেকের মতে স্থানটার নাম যেহেতু ঢাকা ছিল তাই ঢাকার অধিকত্রী অর্থাৎ ঢাকাশ্বরী নাম দেওয়া হয় ।
তার বিক্রমে হিন্দুদের প্রচন্ড প্রভাব তখন সমগ্র রাজ্যে। বৌদ্ধরা আত্মপরিচয়হারা। বিদেশাগত কয়েকজন মুসলমানের অধিবাস ছিল বিক্রমপুরে। কিন্তু স্বাধীনভাবে ধর্মপালন করার অধিকার ছিল না তাদের । নামাজের জন্য আজান দিতে পারতো না। গরু জবাই করলে রাজার কৃপাণের তলায় পেতে দিতে হতো নিজের মাথা। তাই কোনো রকমে গোপনে পালন করতো মুসলমানরা ধর্ম কর্ম।
রাজধানী রামপালের কিছু দূরে আবদুল্লাহপুর গ্রাম। নাম দেখে মনে হয় এই গ্রামে কিছু সংখ্যক মুসলমানের বাস ছিল। দলবদ্ধ হয়েই হয়তো থাকতো তারা। এই গ্রামের একজন মুসলমান অধিবাসীর নাম ছিল সোলায়মান। সোলায়মানের কোনো সন্তান ছিল না। বড় মনোকষ্টে ভুগতো সে। খোদার কাছে দিনরাত কায়মনবাক্যে মাগতো দোয়া, কান্নাকাটি করতো। কিন্তু আশা নিরাশাই রয়ে যায়।
একদিন এক ফকির আসে সোলায়মানের বাড়িতে। খোদার অস্তে দিতে বলে কিছু ভিক্ষা। সোলায়মান মনঃক্ষুন্ন হয়ে রুক্ষ্ম মেজাজে বলে--আর খোদার অস্তে বলো না। খোদার নামে যথেষ্ট করেছি। কিন্তু খোদা আমার দিকে মুখ তুলে চাইলো না। দিলো না একটা ছেলে । খোদার নামে আমি আর ভিক্ষা দেবো না।
ফকির আরো কাছে এসে, আরো অন্তরঙ্গভাবে বললো-কে বলেছে খোদা তোমার বাসনা পূরণ করেনি ? অচিরেই তোমার একটা ছেলে হবে।
---সত্যি?
--মিথ্যে বলবো কেন ?
—তোমার কথা যদি সত্যি হয় তবে তোমাকে পুরস্কার দেবো।
—তোমাকে পুরস্কার দিতে হবে না। আল্লাহর নামে একটা গরু কোরবানী করলেই হবে ।
--আমি তাই করবো, বাবা। আপনি আমার জন্য খোদার কাছে দোয়া করুন।
-করছি। কিন্তু তোমার ওয়াদার কথা মনে থাকে যেন।
ফকির বিদায় নিলো। দেখা গেলো, কিছুদিন পরে সত্যিই সোলায়মানের স্ত্রীর কোল আলো ক'রে ভূমিষ্ঠ হলো এক সুন্দর ফুটফুটে ছেলে। আনন্দ ধরে না সোলায়মানের মনে। কী করবে ভেবে পায় না।
মনে পড়লো তার ফকিরকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা। কিন্তু উপায় ?
গরু কুরবানী করলে তার ঘাড়ে তো মাথা থাকবে না। প্রতিবেশী হিন্দুরা যাবে ক্ষেপে। তারা খবর
পৌছে দেবে রাজার কানে। তখন ছেলেকে মানুষ করবে কে ? কিন্তু ওয়াদা পালন না করলে তার ছেলের যদি কিছু হয় ?
চিন্তা করতে পারে না সোলায়মান। শেষ পর্যন্ত প্রতিজ্ঞা পালনে হয় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। একটা উপায় অবশ্য অনেক ভাবনা চিন্তার পর সে বের করে। একটা গরু নিয়ে সবার অলক্ষে সে চলে যায় লোকালয় থেকে দূরে, এক গভীর জঙ্গলে। সঙ্গোপনে গরুটা কুরবানী করে সেখানে। সামান্য কিছু গোস নিজের জন্যে রেখে অবিশিষ্টংশ পুতে ফেলে মাটির তলায়। নিশ্চিন্ত মনে যাত্ৰা করে গ্রাম অভিমুখে।
দুভাগ্য তার। কোথা থেকে একটা চিল এসে ছোঁ। মেরে তার পাত্র থেকে নিয়ে যায় এক টুকরো গোস।
নিলো তো নিলো।
উড়ে গেলো চিলটা সোজা রাজবাড়ির দিকে। প্রাসাদের উপরে যেতেই তার পা থেকে ফসকে গেলো মাংসখণ্ডটি। পড়বি তো পড় এক্কেবারে প্রাসাদের পূজারীর সামনে। তিনি দেখেই চিনলেন মাংসখণ্ডটি গরুর গোস। বিষয়টা জ্ঞাত করানো হলো রাজা বল্লাল সেনকে।
রেগে আগুন হলেন তিনি। চিৎকার করে বললেন,-কোন পাপাচার হিন্দু দেবতাকে হত্যা করেছে ? তাকে খুঁজে বের করো। হাজির করো আমার সামনে। মহাপাতককে শান্তি দেবো। আমি নিজ হাতে ।
গো-হস্তা মহা পাপিষ্ঠকে খুঁজে বের করার জন্য রাজ আজ্ঞাবাহীরা ছড়িয়ে পড়লো। চারিদিকে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তারা দেখতে পেলো, গভীর জঙ্গলে শেয়ালেরা একটা জন্তুর হাড়গোড় নিয়ে টানাটানি করছে। তাদের বুঝতে অসুবিধা হলো না, এই হাড়ই সেই গরুর হাড়। কিন্তু কে করলো এই কান্ড ?
চলে এলো তারা নিকটবতী লোকালয়ে। আবদুল্লাহপুরে এসে লোকমুখে শুনে অনুমান করলো, এটা ওই সদ্যজাত পুত্রের পিতা সোলায়মানেরই কাজ। গ্রামের অনেকেই ইতিমধ্যে জেনে ফেলেছিল ফকিরের কেরামতির কথা।
খবরগীররা সংবাদ পৌঁছে দিলো রাজা বল্লাল সেনের কাছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে আদেশ দিলেন,-ওই ব্যক্তিকে আগামীকাল ধরে আনবে। হাজির করবে। আমার দরবারে। সাথে নিয়ে আসবে তার সাধের ছেলেটিকে। যার কারণে এই মহাপাপ, দেবতা হত্যা, সেই শিশুকেই করা হবে দ্বিখন্ডিত। সেই পাপিষ্ঠ শিশুকে দুনিয়ার আলো-বাতাস থেকে করতে হবে চির বঞ্চিত ।
মানুষের হিতৈষীর অভাব হয় না। কেমন করে রাজার আদেশ গোপনভাবে পৌছে গেলো অভাগা সোলায়মানের কানে। ভয়ে জান শুকিয়ে গেলো তার । রাতটা মাত্র বাকি । কেমন করে রক্ষা করবে তার প্রাণের ধনকে ?
অযথা সময় নষ্ট না ক’রে কাউকে কিছু না বলে গভীর রাতের গহীন আঁধারে স্ত্রীপুত্ৰ নিয়ে গা ঢাকা দিলো সোলায়মান। রাতের মধ্যেই যেতে চাইলো সে বল্লাল সেনের রাজ্যের বাইরে। বিক্রমপুরের তখন পথ-ঘাট ছিল না। নৌকাই একমাত্র সম্বল। সে পথেই যাত্রা করলো সোলায়মান।
সকাল বেলায় রাজার লোকেরা এসে তাকে পেলো না। কোন পথে, কোন দিকে গিয়েছে। কেউ জানে না। ছুটলো তারা রাজার কাছে। সংবাদ পেয়ে রাজা রাগে অগ্নীশৰ্মা।
আদেশ দিলেন,-যে কোনো উপায়ে তাকে পাকড়াও করতে হবে। আমি নিজ হাতে শাস্তি দিতে চাই সেই পাপিষ্ঠকে ।
নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো রাজার লোকেরা। কিন্তু সন্ধান পেলো না সেই হতভাগ্য দুঃসাহসী মুসলমান পরিবারটির।
পাবে কোথায় ?
সে ইতিমধ্যেই অতিক্রম করেছে বিশাল মেঘনা ; চলতে আরম্ভ করেছে পশ্চিমের দিকে । প্ৰাণভয়ে চলতে চলতে এক সময় ভারতবর্ষের সীমানা অতিক্রম করে সমুদ্রগামী জাহাজে চড়ে পৌঁছে গেছে পবিত্র মক্কা শরীফে।
বিধর্মিদের দেশে অবস্থান করার সাধ তার মিটে গেছে। এসেছিলও সে পশ্চিমের কোনো মুসলিম দেশ থেকে।
দৈবক্রমে একদিন তার সাক্ষাৎ হলো বাবা আদম নামক একজন কামেল দরবেশের সাথে। অকপটে তার কাছে ব্যক্ত করলো সুলায়মান সবকিছু।
আনুপূর্বিক বৃত্তান্ত শুনে অবাক হলেন বাবা আদম। এমন দেশও পৃথিবীতে আছে ? রাজা যে ধর্মের অনুসারীই হোক না কেন, মানুষ কেন পারবে না স্বাধীনভাবে ধর্মকর্ম করতে?
ঠিক আছে, আমি যাবো সেই দেশে। শিক্ষা দেবো অত্যাচারী রাজাকে । আদায় করবো মানুষের স্বাধীনতা । নির্ভয় চিত্তে মানুষের ধর্ম পালনের অধিকার করবো আদায়।
কয়েকশত অনুসারী নিয়ে বাবা আদম যাত্রা করলেন ভারতবর্ষ অভিমুখে । বহু দিন ধরে দুস্তর পথে বহু বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে অবশেষে পৌছলেন তিনি বিক্রমপুরের উপকণ্ঠে। রাজা বল্লাল সেনের প্রাসাদের অনতিদূরে গাড়লেন আস্তানা। প্রথমে স্থাপন করলেন একটা মসজিদ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় উচ্চস্বরে আজান দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। আরম্ভ করলেন জামাতে নামাজ পড়া।

বিচলিত হলেন রাজা বল্লাল সেন। তার আমলে বৌদ্ধদের প্রাদুর্ভাব গিয়েছিল কমে। মুসলমানদের অধিবাস ছিল না বললেই চলে। ধর্ম, কৃষ্টি, শিক্ষা, সংস্কৃতিতে একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল হিন্দুদের। মুসলমান বসতি অবাধে গড়ে উঠলে সেটা হবে নতুন বিপদ।
তাই দরবেশ বাবা আদম ও তার সহস্রাধিক অনুসারীর কার্যকলাপ মনে প্ৰাণে গ্রহণ করতে পারলেন না রাজা বল্লাল সেন।
কিছুদিন পরে দেখা দিলো। নতুন উপসর্গ। দরবেশের অনুগামীরা জবেহ করতে আরম্ভ করলেন এ-অঞ্চলে সহজ প্ৰাপ্য গরু-ছাগল । এত লোকের খাদ্য গোপন স্থানে পাক করা সম্ভব ছিল না। আরববাসীরা মাছ খাওয়াতেও ছিল না অভ্যস্ত। ফলে সহজলভ্য বিশালদেহী গরুই জবেহ হতে লাগলো প্রত্যহ। আরবীয় পাকের খুসরু ছড়াতে লাগলো বাতাসে বাতাসে।

ব্যাপারটা অসহ্য হয়ে উঠলো। রাজা বল্লাল সেনের কাছে। কিন্তু শত শত আরবীয় বীর সেনানীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে সাহস পাচ্ছিলেন না তিনি। দেশে দেশে আরব মুসলমান বীর সোনানীদের বিজয় অভিযানের কথা তার জানা ছিল।

প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে গিয়ে পরাজিত হলে শুধু ধর্ম নয়, তার রাজ্য নিয়েও টান পড়বে। তাই দরবেশের বিরুদ্ধে অস্ত্ৰধারণ করতে তিনি সাহস পাচ্ছিলেন না। আবার নির্বিবাদে সহ্য করাও ছিল কষ্টসাধ্য। প্রজাদের নিকট হতে হচ্ছিল তাকে ছোট হীনবল । তার দুঃসাহস আর ধর্মানুরাগ দেখে এসেছে প্রজাবৃন্দ। তারই কারণে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সরে পড়েছে বিক্রমপুর থেকে।
দেশে আনুষ্ঠানিক ধর্মানুষ্ঠান পরিচালনা করার উপযোগী ব্ৰাহ্মণ না থাকায় তিনি কনৌজ রাজ্য থেকে কয়েকজন শিক্ষিত ব্ৰাহ্মণ আমদানি করেছিলেন। পূজা পার্বনের পৌরহিত্যে এবং হিন্দুধর্ম পুনর্জাগরণে ব্ৰাহ্মণদের স্বাধীনভাবে কাজ করার পূর্ণ অধিকার দিয়েছিলেন তিনি। ধন-সম্পদ, মান-সম্মানে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি কনৌজ  থেকে আগত ব্ৰাহ্মণদের। সংস্কার করেছিলেন হিন্দু জাতীয়তাবাদের। কঠোরভাবে চালু করেছিলেন জাতিভেদ প্রথা। সেই গোড়া হিন্দুরাজা বল্লাল সেন কেমন করে সহ্য করবেন আরব থেকে আগত মুসলমানদের গৰ্হিত কার্যকলাপ ?
---রাজা বল্লাল সেন শেষ পর্যন্ত সহ্য করলেন না । তার কয়েকজন শক্তিমান সাহসী দূতকে পাঠালেন দরবেশের কাছে।
----তাকে বলা হলো--হিন্দুরা দেবতাজ্ঞানে পূজা করে গরুকে । গরু হিন্দুদের দেবতা। গো-হত্যা নিষিদ্ধ সেন রাজত্বে। আপনি রাজআজ্ঞা ভঙ্গ করছেন। অবাধে গো-হত্যা করছেন। এই অনাচার বন্ধ করতে হবে।
দরবেশ ধীর স্থিরভাবে বললেন-কোনো পশু মানুষের উপাস্য হতে পারেনা। আদর-যত্ন করা, প্রতিপালন করা আর পূজা করা এক কথা নয়। একমাত্র স্রষ্টাই মানুষের উপাস্য। অন্য সকল প্রাণী-মানুষের তাবেদারে। মানুষের কল্যাণের জন্যই তাদের সৃষ্টি। গরুর গোস উপাদেয় খাদ্য । হালালও বটে। কেন তবে আমরা গরু জবাই করতে পারবো না ?
—আপনার ধর্ম আর আমাদের ধর্ম এক নয়। আপনাদের ধর্মে যেটা সিদ্ধ, আমাদের ধর্মে সেটা অন্যায়।
আমাদের রাজত্বে অবস্থান করে আপনারা সেই মারাত্মক অন্যায় করতে পারবেন না।
গরু খাওয়ার কোনো অন্যায় নেই।
বললাম তো, গরু আমাদের দেবতা। আমরা গরুকে পূজা করি।
---তোমাদের দেবতাকে খেয়ে যারা হজম করতে পারে তারাই তাহলে বড় দেবতা ।
মুসলমানরা গরুর চাইতে শ্রেষ্ঠ ।
দরবেশের কথা শুনে রাগে রোষে ফেটে পড়লেন রাজা বল্লাল সেনের অন্যতম ব্ৰাহ্মণ প্রতিনিধি। তিনি কৰ্কশ কণ্ঠেই বললেন--আজান দেওয়া আর গরু খাওয়া বন্ধ করতে হবে ।
দরবেশ শান্ত মেজাজে অথচ দৃঢ়তার সাথে বললেন,—করবো না।
--তাহলে আমাদের রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে হবে।
--রাজ্য ত্যাগ করার জন্য আমরা আসিনি।
বিনা দোষে সোলায়মানের শিশু পুত্রকে তোমরা হত্যা করতে চেয়েছিলেন। বেচারার ক্ষমতা ছিল না প্ৰতিবাদ করার। হিম্মত ছিল না রুখে দাঁড়ানোর। তাই সে দেশত্যাগ করেছিল।
আমরা অতো দুর্বল নই। খোদা ছাড়া পৃথিবীতে আর কারো কাছে অন্যায় ভাবে আমরা মাথা নত করি না।
তোমাদের রাজাকে--বলবে, আমরা এখানে থাকবো এবং গো-হত্যা করবো। আজানও দেবো ।
দরবেশের জবাব শুনে অপমানিত বোধ করলেন রাজা বল্লাল সেন । তিনি শক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত হতে বললেন যুদ্ধের জন্য। সাজ সাজ রাব পড়ে গেলো রাজধানীতে ।
সংবাদ চলে এলো দরবেশের কাছে। তিনিও তার সঙ্গীদের প্রতি আদেশ দিলেন-- তৈরি হও। শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য হও প্রস্তুত। জয়লাভ করলে এদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে ইসলামের ন্যায়নীতি ও সমতা। আর মৃত্যু হলো পাবে শহীদের দরজা।
একটা প্ৰাণী জীবিত থাকতে অন্যায়ের কাছে পরাজয় স্বীকার করবো না। প্রয়োজনবোধে কুরবান করবে নিজেদের জীবন।
প্রস্তুতি গ্ৰহণ করলো দু'পক্ষই। মুসলমানেদের রণ কৌশলের বিশ্বজোড়া খ্যাতি জানা ছিল রাজা বল্লাল সেনের। তাই জয় পরাজয়ের আশঙ্কা ছিল তার অন্তরে । তাই আগে থেকেই সাবধানতা অবলম্বন, প্রাসাদের আধিবাসীদের উদ্দেশ্যে বিদায়কালে  -- বিজয় আমাদের হবেই, কয়েকশত বিদেশিকে পরাজিত করা আমার বাহিনীর পক্ষে কঠিন কিছু নয়। তবু সাবধানের মার নেই। আমরা যদি পরাজিত হই, তবে তোমরা অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপ দিয়ে সবাই আত্মাহুতি দেবে। মুসলমানেরা যেন তোমাদের দেহ স্পর্শ করার সুযোগ না পায়। ওরা ভয়ানক হিংস্র। নির্বিবাদে পুরুষদের হত্যা করবে। হয়তো মেয়েদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে বিয়ে করতে চাইবে। সে সুযোগ তাদের দেওয়া যাবে না।
--জয়-পরাজয়ের খবর আমরা জানবো কি করে ?
-আমি একটা পায়রা নিচ্ছি জামার মধ্যে। একান্তই যদি পরাজিত হই। তবে মরার আগে পায়রাটা ছেড়ে দেবো। ওটা ফিরে আসলেই বুঝবে আমরা পরাজিত। দেরী না করে সঙ্গে সঙ্গে সদলবলে ঝাঁপিয়ে পড়বে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে।
অর্থাৎ ১৪৮৩ সালে যেখানে “বাবা আদম মসজিদটি তৈরি করেছিলেন জালালউদ্দীন ফতেহ শাহ, সেখানেই সমবেত করলেন তার বিশাল বাহিনীকে। মুখোমুখি দাঁড়ালো উভয় পক্ষের যোদ্ধাগণ। বাংলার ভাটি অঞ্চলে মুসলিম অভিযানের অগ্রপথিক, ইসলামে নিবেদিত প্ৰাণ বাবা আদমের ভয়লেশহীন অনুসারীরা শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হল সেনের দুর্ধর্ষ সৈন্য বাহিনীর সাথে। আরম্ভ হলো রক্তক্ষয়ী সম্মুখ সমর।

প্রথম দিনে উভয় পক্ষের বিস্তার ক্ষয়-ক্ষতি হলেও নির্ধারিত হলো না জয়-পরাজয় । দিন শেষে ঘোষিত হলো যুদ্ধবিরতি ।
পরদিন আবার শুরু হলো প্রচন্ড যুদ্ধ। কিন্তু দিন শেষে ফলাফল রইলো একই। চললো আরো কয়েকদিন। রাজার দলে প্রত্যেকদিন যোগদান করতে লাগালো নতুন সেনাদল। পূরণ হতে থাকলো মৃত সৈন্যদের শূন্যস্থান। কিন্তু দরবেশের সঙ্গীসংখ্যা কমতে থাকলো ক্ৰমান্বয়ে। পুরণ হবার কোনো উপায় ছিল না। ফলে একদিন নিঃস্ব হলো তাঁর অনুসারীদের সংখ্যা। চূড়ান্ত পরাজয় বরণ করতে হলো মুসলমানদের।
সুর্য তখন ডুবে গেছে। পশ্চিমাঞ্চলে। মাগরিবের নামাজে দাঁড়িয়েছেন বাবা আদম । এমন সময় বিজয়ী বেশে উন্মুক্ত তরবারি হাতে সেখানে হাজির হলেন স্বয়ং রাজা বল্লাল সেন। দেরী সহ্য হলো না তার।
---প্রচন্ড আঘাত হানলেন দরবেশের স্কন্ধাদেশে। কিন্তু ফল হলো না কিছুই। পাগড়ির ঝুলন্ত অংশ পর্যন্ত রইলো অক্ষভ | অবাক হলেন বল্লাল সেন। তরবারি উত্তোলন করলেন আবার । এই সময় নামাজ শেষ হলো বাবা আদমের । সালাম ফিরায়ে আরম্ভ করলেন দীর্ঘ মোনাজাত। মোনাজাত শেষে অনেক কথা কাটাকাটি হলো রাজার সাথে। পরিশেষে তিনি বললেন---খোদার ইচ্ছায় বিধর্মীর হাতেই মুহুর্তে মৃত্যু হবে আমার। কিন্তু তোমার তরবারিতে নয়। এই নাও আমার তরবারি আঘাত হানো। এবার ঠিক কামিয়াব হবে। তবে তুমি বাঁচতে পারবে না। খোদার অভিশাপ নেমে আসবে তোমার উপরে । তোমার পাপে অনেক নিরীহ ব্যক্তি হয়তো প্ৰাণ হারাবে। দম্ভকে খোদা সহ্য করেনা। নিজের ভালো তুমি বুঝলে না।
জায়নামাজের নীচ থেকে তরবারিটা বের করে দিলেন বাবা আদম ।
বললেন---এবার আঘাত হানো ।
যন্ত্র চালিতের মত বাবা আদমের তরবারি হাতে নিলেন রাজা বল্লাল সেন, তরবারি আদমের মাথার উপর উত্তোলন করে বললেন--এতোদিন অনর্থক ভয় করতাম মুসলিম শক্তিকে। অনেক রাজা মোকাবেলা করতে সাহস পাননি মুসলমানদের। কিন্তু আমি দেখলাম, কিছুই না। সাহস করলে, বীরের মতো যুদ্ধ করতে পারলে মুসলমানদের পরাজিত করা কঠিন কিছু নয়।
--রাজা, ভুল করছো। আমরা যোদ্ধা নই। ধর্ম প্রচারক। মুসলিম সৈনিকদের সাথে শক্তি পরীক্ষার সুযোগ তোমার জীবনে হবে না। তার আগেই খোদার অভিশাপ নেমে আসবে তোমার পরিবারে। নির্বাংশ হবে তুমি।
দরবেশের কথা শেষ হতে পারলো না। দাঁড়িয়ে অভিশাপ শোনার ধৈর্য তার ছিল না। দরবেশের তরবারি দিয়েই আঘাত হানলেন তিনি দরবেশের স্কন্ধে। এবার সহজে দ্বিখণ্ডিত হল বাবা আদমের দেহ। আনন্দে আত্মহারা হইয়ে তরবারি দূরে ছুড়ে ফেলে দিলেন রাজা। 
এই সময় কোন ফাঁকে তার জামার নীচ থেকে পায়রা বেরিয়ে গিয়েছিল, জানতে পারেননি তিনি। বিজয়ের আনন্দে তখন তিনি আত্মহারা ।
আত্মীয়বর্গ তখন প্রাসাদের ছাদে দাঁড়িয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন দিনশেষে যুদ্ধের খবর শোনার জন্য। সেদিন কোনো দূত যায়নি। পতপত করে হাজির হয়েছিল বল্লাল সেনের নিয়ে যাওয়া সেই বিশেষ পায়রাটা । পায়রা জানতো না, কতো মারাত্মক পরিণতির ভয়াবহ সংবাদ সে পৌঁছে দিয়েছিল প্ৰাসাদের অধিবাসীদের কাছে।
মুহুর্তে মৰ্মভেদী কান্নার রোল উঠলো সমগ্র রাজপ্রাসাদে। বিলাপ করার সময় ছিল না তাদের হাতে। অগ্নিকুণ্ডে শুকনো কাঠ সরবারহ করা হলো। বেশি পরিমাণে ঢেলে দেওয়া হলো কয়েক টিন ঘি। বিজয় উন্মত্ত মুসলিম সেনারা অচিরেই পৌছে যাবে প্রাসাদে। ইজ্জত নষ্ট করা হবে “রণগর্বি, জাত্যাভিমানী’ রাজপরিবারের কুলশীল রমনীদের।
তাই সময় ক্ষেপণ না ক’রে তারা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লো জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে । শেষ হলো সকল গর্ব, চূর্ণ হলো রাজা বল্লাল সেনের দর্প।
হঠাৎ প্রাসাদের দিকে নজর গেল রাজা বল্লাল সেনের। রাতের গহীন আধার ছিন্ন ক’রে প্রাসাদের লেলিহান শিখা দূর থেকে স্পষ্টতর হলো তার দিব্যচক্ষে। অবাক হলেন তিনি। জামার নীচে বুকে হাত দিয়ে দেখলেন, যথাস্থানে নেই পায়রাটা । উম্মাদ হয়ে গেলেন তিনি। দরবেশের অভিশাপের কথা মনে হলো তার। কাউকে কিছু না বলে পাগলের মতো ছুটলেন তিনি প্রাসাদ অভিমুখ। সর্বনাশ হবার আগেই যে-কোনা উপায়ে পৌছতে হবে তাকে রাজ-বাড়িতে। রক্ষা করতে হবে প্ৰাণপ্ৰিয় আত্মীয়বৰ্গকে।
পৌঁছলেন তিনি ঠিকই। কিন্তু সব নিঃশেষ হয়ে গেছে তার আগেই। একজনও বেঁচে নেই আপনজন। মনের দুঃখে সেই জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে ঝাপ দিলেন তিনিও ।
বল্লাল সেনের বড় কুমার লক্ষণ সেন সপরিবারে ছিলেন তখন নদীয়ায়। পরবর্তীকালে বখতিয়ার খিলজীর ভয়ে তিনি প্ৰাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন বিক্রমপুরে। তার পরিবার ব্যতীত নিয়তির অমোঘ বিধানে এইভাবে শেষ হয়েছিল বিক্রমপুরে অবস্থানরত সেন বংশের প্রতিটি অহঙ্কারী সদস্য।
বইঃ ঢাকার ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি- আনিস সিদ্দিকী

নোয়াখালিতে হিন্দু নিধন

$
0
0

নোয়াখালিতে হিন্দু নিধন
১৯৪৬ সালে ১৬ আগস্ট কলকাতায় হিন্দু-মেধ যজ্ঞে মুসলমান পরিপূর্ণ তৃপ্তি লাভ করতে পারেনি। দাঙ্গার তৃতীয় দিনে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখাজীর নেতৃত্বে হিন্দু-শিখ জনতা গড়ে তোলে প্রতিরোধ। সফল হয় না জেহাদের উদ্দেশ্য। ক্রুদ্ধ মুসলমান হিন্দুকে চরম শিক্ষা দিতে বেছে নেয় রাজধানী কলকাতা হতে বহুদূরে পূর্ব বাংলার নোয়াখালি জেলা।
**এই জেলার লোকসংখ্যার ৮২% মুসলমান; হিন্দু মাত্র ১৮% ।**
জায়গাটা নদী-খাল ঘেরা দুৰ্গম। প্রাদেশিক মুসলিম লীগের তদানীন্তন সম্পাদক আবুল হাশিম লিখছেন, ২৯ আগস্ট নোয়াখালি জেলায় হঠাৎ আকস্মিক উত্তেজনার সৃষ্টি হল। “মৌলানা গোলাম সারওয়ারের*{ দাঙ্গার পরে গান্ধী নোয়াখালি গেলে তঁরা দেখাশুনার দায়িত্ব দেওয়া হল মুসলীম লীগের M. L. A. এই গোলাম সারওয়ারের ওপর।}
নেতৃত্বে ৭ সেপ্টেম্বর নোয়াখালির মৌলবীদের এক সভায় ঘোষণা করা হয় যে কলকাতা হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মুসলমানদের যথাযথ ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। নোয়াখালি এবং কুমিল্লার সর্বত্র দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল এবং সময়োচিত ব্যবস্থা গ্ৰহণ না করলে পূর্ববঙ্গের সমস্ত জেলাব্যাপী দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ত।
সুরাওর্দি আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার আপ্ৰাণ প্রচেষ্টা করেছিলেন।” সুরাওর্দির এই আপ্রাণ প্রচেষ্টার রকমটা কি তা সুচেতা কৃপালনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন। মৌলবীদের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শুরু হয় ব্যবস্থা গ্ৰহণ। হিন্দুদের পলায়ন পথ বন্ধ করতে রাস্তা কেটে দেওয়া হয়, উপড়ে ফেলা হয় রেল লাইন। নৌকা, লঞ্চ ও স্টিমার দিয়ে অবরোধ করা হয় জলপথ। অতঃপর ১০ অক্টোবর লক্ষ্মী পূজার দিন স্থানীয় বিধান সভার সদস্যের নেতৃত্বে ২৫০ বর্গমাইল ব্যাপী বিস্তৃত অঞ্চলে শুরু হয় ব্যাপকভাবে হত্যা, লুণ্ঠন, গৃহদাহ, শত শত হিন্দু নারী অপহরণ, ধর্ষণ ও চরম লাঞ্ছনা ও নির্যাতন সহ মুসলমানের ঘরে আটক রাখা, বলপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তর প্রভৃতি।
কোন কোন স্থানে সিমান্তে হিন্দু পরিবার প্ৰতিবাদ বা প্রতিরোধের চেষ্টা করলে সেই পরিবারের সকলকে হত্যা করার ঘটনা মধ্যযুগের ব্যাপক বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার কাহিনীকেও হার মানিয়েছে।
প্রায় এক সপ্তাহকাল সুরাবন্দির মন্ত্রিসভা অথবা বাংলা সরকারের নির্দেশে এই নিৰ্মম অত্যাচারের কাহিনী গোপন রাখা হয়েছিল, ১৭ অক্টোবর সর্বপ্রথম এই সংবাদ প্রকাশিত হয়। “সংবাদপত্রের বিবরণ অনুসারে পাঁচ হাজার লোক হত ও ইহার বহুগুণ আহত এবং প্রায় দেড় লক্ষ লোকের গৃহ বিধ্বস্ত হয়।”
বাংলা সরকার এডওয়ার্ড স্কিনার সিম্পসন (Edward Skinner Simpson) একজন অবসর প্রাপ্ত জজ সাহেবকে ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব দেন। তাহার রিপোর্টে তিনি মুসলিম লীগ দল ও মন্ত্রিসভাকে এই বীভৎস ঘটনার জন্য দায়ী করেন। সরকার এই রিপোর্ট প্রকাশ না করে চেপে রাখেন।
যাহোক রিপোর্টের একটি কপি The Statesman পত্রিকার হস্তগত হয়। সম্পাদক অনেক কাটছাট করে যেটুকু ছেপেছিলেন, নিম্নে তার ভাবাৰ্থ দেওয়া হল :
“নোয়াখালি ও ত্রিপুরা জেলার যেখানে যেখানে মুসলমান আক্রমন চালাইয়াছিল, তাহার প্রায় সর্বত্রই বাড়িঘর, জিনিসপত্র, দোকানপাটের এমন নির্মূল ভাবে ধ্বংস ক্রিয়া সম্পন্ন হইয়াছে যে বিরাট ধ্বংসাবশেষের পুঞ্জীভূত স্তুপ ছাড়া আজ আর কিছুই অবশিষ্ট নাই। ...ত্রিপুরা জেলার চাঁদপুর থানার অন্তর্গত বাইচরের দৃশ্য অবর্ণনীয়। উন্মত্ত হিংস্ৰ জনগণের ধ্বংসাত্মক কার্যের সম্বন্ধে প্রকৃত ধারণা করিতে হইলে এই স্থানটি দেখা দরকার।
এই রিপোর্টে ধর্ষিতা হিন্দু-নারীর সংখ্যা নির্ণয়ের চেষ্টা করা হইয়াছে। কিন্তু অনেকে এই সম্বন্ধে কিছু বলিতে অনিচ্ছুক হওয়ায় সঠিক সংখ্যা বলা যায় না। কিন্তু উক্ত কর্মচারীটির কাছে অনেকে সাধারণভাবে রিপোর্ট করিয়াছেন এবং কোন কোন বাড়ীতে বা স্কুল ঘরে হিন্দু-স্ত্রীলোকদিগকে ৩/৪ দিন আটক করিয়া রাখা হইয়াছিল।
জোর করিয়া ব্যাপকভাবে দলে দলে হিন্দুদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত (Mass Conversion) করার বিবরণ প্রত্যেক গ্রামেই পাওয়া গিয়াছে। অনেক স্থানে পুরুষেরা আপত্তি করিলে তাহাদের স্ত্রীলোকদিগকে আটক করিয়া রাখিয়া তাহাদিগকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিতে বাধ্য করা হইয়াছে। অনেককে প্ৰাণবধের ভয় দেখাইয়া ধর্ম পরিবর্তন করিতে বাধ্য করা হইয়াছে।” { রমেশ চন্দ্র মজুমদার—বাংলা দেশের ইতিহাস—৪ খণ্ড, পৃঃ ৪২০}
নোয়াখালি দাঙ্গার বিশদ আলোচনা ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন। কেহ কেহ বলেন বাঙালী মুসলমান ভাল (যেন শুধু অবাঙালী মুসলমানই যত অশান্তির কারণ)। বাংলায় হিন্দুমুসলমান পাশাপাশি বাস করে। তাদের এক ভাষা, এক সংস্কৃতি। যদিও এই সকল ব্যক্তিরা জানেন যে মুসলমান কখনও মিজেকে বাঙালী, বিহারী বা মাদ্রাজী বলে পরিচয় দেয় না।
“মুসলমান”—এই তার একমাত্র পরিচয়। ভারতে হাজার বছর ধরে মাহমু,বাবর-নাদির শাহরা যে অত্যাচার করেছে, কলকাতা-নোয়াখালির বাঙালী (?) মুসলমানও বাঙালী হিন্দুর ওপর সেই একই অত্যাচার করেছে। অত্যাচারের পদ্ধতি ও প্রকৃতিও এক। এটাই তো স্বাভাবিক। **উভয়েরই মূল প্রেরণা তো পবিত্র ইসলাম ধর্ম।** নোয়াখালিতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ্য দিবালোকের ন্যায় উদভাষিত হয়েছে।
ইংরেজ আই. সি. এস. অফিসার এ. আই. রোম্যান (উত্তর প্রদেশে কর্মরত) উত্তর প্রদেশের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থকে বাংলার দাঙ্গা সম্বন্ধে এক দীর্ঘ পত্র লেখেন। সেই পত্রে তিনি বলেন : “এ সত্যটি গোপনের চেষ্টা করে লাভ নেই যে গুন্ডারা বাংলাকে ধ্বংস করছে তাদের নেতা হচ্ছেন সুরাওর্দি ও তীর মন্ত্রীরা।”1. শংকর ঘোষ—হস্তান্তর (৯ম পর্ব) সাপ্তাহিক দেশ—৭-৩-৯৮.
কলকাতা থেকে শংকর ঘোষ সহ চার জন সাংবাদিক গিয়েছিলেন নোয়াখালিতে দাঙ্গার রিপোর্ট করার জন্য। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা না থাকায় তঁরা নোয়াখালির অভ্যন্তরে ঢুকতে পারছিলেন না। সেই সুযোগ ঘটল যখন চাঁদপুর স্টেশনে হঠাৎ একদিন তদানীন্তন চীফ মেট্রোপলিটান ম্যাজিষ্ট্রেট রণজিৎ গুপ্তের সঙ্গে দেখা হয়। রণজিৎ গুপ্তকে (পরে ইনি পঃ বাংলার মুখ্য সচিব হয়েছিলেন) সুরাওর্দি সরকার নোয়াখালির দাঙ্গার তদন্তের ভার দিয়েছিলেন তার উপর তদন্তের ভার ছিল, লিখছেন শংকর ঘোষ, “কিন্তু নোয়াখালির অভ্যন্তরে হাজার-হাজার আটক হিন্দুদের উদ্ধার করার ক্ষমতা তাকে দেওয়া হয়নি। অথচ তদন্তের কাজে তিনি যেখানেই যেতেন সেখানেই হিন্দুরা তাদের দুর্দশা ও লাঞ্ছনার বর্ণনা করে বন্দিদশা থেকে উদ্ধারের জন্য তাকে বলতেন।.
তাই তিনি একটি কৌশল উদ্ভাবন করেছিলেন, তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য একটি সশস্ত্র রক্ষিবাহিনী সর্বত্র তাঁর সঙ্গে যেত। রণজিৎ গুপ্ত তদন্তেৰ জন্য যে গ্রামে যেতেন সেখানকার হিন্দুরা তাকে নিরাপদে কোনও আশ্রয়ে নিয়ে যেতে বললে তিনি তাদের স্পষ্ট জানিয়ে দিতেন যে তার সে ক্ষমতা নেই। তবে তারা ইচ্ছে করলে তিনি ফিরে যাবার সময় তার দলের পিছে আসতে পারেন। এই কৌশলে তিনি কয়েক হাজার নর-নারীকে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন। তাতে মুসলিম আক্রোশ বাড়তেই থাকে। একদিন যখন তীর সশস্ত্র রক্ষীদের পিছন পিছন এরকম একটি দুৰ্গতি নরনারীর দল গ্রাম ছেড়ে চলে আসছে তখন একটি বিরাট মুসলিম জনতা তাদের আক্রমণ করে খুন-জখম, লুঠপট শুরু করে দেয়।
রণজিৎ গুপ্ত তখন তাঁর রক্ষিদের গুলি চালাবার নির্দেশ দেন। যত দূর মনে পড়ছে, ওই গুলি চালনায় উন্মত্ত মুসলিম জনতার জন কুড়ি মারা গিয়েছিলেন। মুসলীম লীগ মন্ত্রিসভা রণজিৎ গুপ্তের কৈফিয়ত তলব করেছিল।”2. শংকর ঘোষ—হস্তান্তর (৯ম পর্ব) সাপ্তাহিক দেশ-৭—৩-৯৮
নোয়াখালির হিন্দু-নিধন সম্বন্ধে সাংবাদিক শংকর ঘোষ বলেন, ---“নোয়াখালি ও ত্রিপুরার হাঙ্গামা যে পর্যন্ত যা দেখেছিলাম এবং পরে গান্ধিজির সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরে যা জেনেছিলাম তাতে কলকাতার দাঙ্গার সঙ্গে ওই দুটি জেলার হাঙ্গামার তফাতটি বেশ চোখে পড়ছিল।কলকাতায় যা ঘটেছিল সেটি দাঙ্গা, হিন্দু-মুসলমান দুটি সম্প্রদায়েই তাতে সক্রিয় অংশ নিয়েছিল.কিন্তু নোয়াখালি ও ত্রিপুরাতে যা হয়েছিল সবই একতরফা। এই দুই জেলায় যা ঘটেছিল তাকে দাঙ্গা বলা যায় না, হাঙ্গামা বললেও ঠিক বোঝানো যাবে না। কেননা এই দুই জেলায় কোথাও হিন্দু প্রতি-আক্রমণ তো দূরের কথা, প্রতিরোধও করতে পারেনি। বিশেষ করে নোয়াখালিতে যা হয়েছিল তা ছিল হিন্দুদের নিশ্চিহৃ করার অভিযান।”
আচার্য কৃপালনি, তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি। সুরাওর্দি সরকারের অসহযোগিতার জন্য দু’বারের চেষ্টায় তিনি নোয়াখালি যেতে পেরেছিলেন। তারপর গিয়েছিলেন ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, শরৎ বসু প্রভৃতি নেতৃবৃন্দ।
বাংলার মেয়ে সুচেতা কৃপালনি স্বামীর সফর সঙ্গিনী হয়েছিলেন। **মুসলমানের যৌন লালসা হিন্দু নারীদের মধ্যে এরূপ আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল যে সুচেতা কৃপালনি সঙ্গে নিয়েছিলেন তীব্র বিষ আর্সেনিক।** যদি প্রয়োজন হয়...। “তিনি প্রত্যহ সকাল বেলা বেরিয়ে পড়তেন বিধ্বস্ত এলাকা ঘুরে দেখার জন্য।...অনেকেই তার সঙ্গে ত্ৰাণ শিবিরে চলে আসতেন, অত্যাচার ও নির্যাতনসহ্য করে, ধর্ম ও সম্মান হারিয়ে তারা গ্রামে থাকতে চাইতেন না। স্থানীয় মুসলমানরা হিন্দুদের এই চলে আসা পছন্দ করতেন না। তঁরা বাধা দিতেন, মধ্যপথে শরণার্থীদের আক্রমণ করে তাদের খুন জখম করে তাদের অবশিষ্ট যা কিছু লুটপাট করে নিয়ে যেতেন। সুচেতা নিজেও বিপন্মুক্ত ছিলেন না। একদিন রাতে তারা খবর পান যে একটি মুসলিম জনতা তাদের আক্রমণ করতে আসছে। এই জনতাকে বাধা দেওয়ার শক্তি তাদের ছিল না। তারা মরার জন্য তৈরি হন। সুচেতা লিখেছেন “আমার সঙ্গে বিষ থাকায় গুণ্ডাদের হাতে পড়ার কোনও ভয় আমার ছিল না।” তার সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী ছেলেরা তা জানত না। তারা যে কোনওরকম বিপদের জন্য তৈরি হয়েছিল। সৌভাগ্যবশত এই মুসলিম জনতা তাদের শিবিরের কাছে এসেও কোনও কারণে ফিরে যায়।”
সব কিছুরই তো একটা উদ্দেশ্য থাকে। সুচেতা কৃপালনি তঁর মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা থেকে আত্মজীবনীতে লিখেছেনঃ “নোয়াখালি ও কুমিল্লায় হাঙ্গামা সৃষ্টিকারীদের উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুদের মর্যাীল এক্সটারমিনেশন। তাই নােয়াখালি ও ত্রিপুরায় নরহত্যা তত হয়নি যত হয়েছে ধর্ম ও সংস্কৃতি নাশের চেষ্টা। গ্রামের পর গ্রামে হিন্দুদের ধর্ম নাশ করার চেষ্টা হয়েছে, কলমা পড়ানো হয়েছে, গরুর মাংস খেতে, লুঙ্গি পরতে, নূর রাখতে বাধ্য করা হয়েছে, হিন্দু মেয়েদের জোর করে মুসলিম ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে হিন্দু মেয়েদের মুসলিম বাড়িতে রাত্রি যাপনে বাধ্য করা হয়েছে।”
বইঃমুসলিম শাসন ও ভারতবর্ষ----নিত্যরঞ্জন দাস

প্যাপিরাসের ইতিহাস

$
0
0

প্যাপিরাসের ইতিহাস
প্রাচীনকালে লোকে প্যাপিরাসের ওপর লিখত; এটি এমন এক উপাদান স্বাভাবিক পরিবেশ-পরিস্থিতিতে যা মাত্র কয়েকশ বছর টেকে। ফলে যিশুর জন্মের কাছাকাছি সময়ের ধ্রুপদী যুগের উৎকীর্ণ লিপি ছাড়া প্রায় কিছুই টেকেনি। সে-সময়ে যা কিছু লেখা হয়েছিল তার বেশির ভাগই প্যাপিরাস নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে হারিয়ে গেছে। তারপরেও যে প্রাচীন যুগের সাহিত্যের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আমাদের কাছে আছে তার কারণ হলো, নষ্ট হয়ে যাওয়ার আগে সেগুলো প্রায়ই নকল করা হতো, কাজেই সে-সব আরেকটু বেশি দিনের জন্য সংরক্ষিত হয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে, চৰ্মপট বা চৰ্মপত্র (parchment) বলে একটা নতুন উপাদান প্রাচীন যুগের শেষের দিকে ব্যবহার হতে শুরু করে। সেটা ছিল জীবজন্তুর চামড়া দিয়ে তৈরি, এবং এই পাত বা ফলকগুলো ছিল কঠিন, দেখতে প্রায়ই হলদেটে, খুবই শক্ত, আর টেকসই। সেগুলোকে গুটিয়ে রাখা যেত না, কাজেই তার বদলে বড় বড় পাত বা ফলকগুলোকে ভাঁজ ক’রে সুবিধামতো পাতার আকার দেয়া হতো, তারপর সেগুলোকে একসঙ্গে বান্ডিলের মতো করে একপাশে সবগুলোকে ওপর থেকে নিচের দিকে সেলাই ক’রে জুড়ে দেয়া হতো। সেলাই-করা শিরদাঁড়া বা পুটটি এরপর একটা শক্ত আবরণের সঙ্গে বাঁধা হতো। আর এভাবেই আবিষ্কৃত হলো বই, কার্যত যা এখনো এভাবেই তৈরি হয়।
চর্মপটের তৈরি বই চতুর্থ শতকে জনপ্রিয়তা লাভ করে। কিন্তু তারপরেও প্যাপিরাস বেশ কিছু শতক ধরে ব্যবহৃত হতে থাকে, যদিও ধীরে ধীরে তা পুরোপুরি হারিয়ে যায়। এ-কথা সত্য যে, তুলনামূলকভাবে চর্মপট তৈরি অধিক সময়সাপেক্ষ, কিন্তু গৃহপালিত পশু সবখানেই লভ্য ছিল, ওদিকে প্যাপিরাস মিশর থেকে আমদানি করতে হতো।
ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বাণিজ্য ক্রমেই কমে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি থেমে যেতে পশ্চিম ইউরোপে প্যাপিরাস আসা-ই বন্ধ হয়ে গেল। প্ৰযুক্তির এই পরিবর্তনটি লাতিনের পক্ষেই গেল বরং ।
প্যাপিরাসের রোল থেকে কেউ কোনো লাতিন টেক্সট চর্মাপটে নকল করলে সেই টেক্সট আরো বেশিদিন টিকে যেত।
প্ৰাচীন যে-সব টেক্সট আমাদের কাছে এখনো আছে সেগুলো চর্মাপটে নকল করা হয়েছিল। এ-রকম একটি নকল তৈরি করা সময় ও অর্থের দিক দিয়ে বড়সড় একটি বিনিয়োগই ছিল বটে, কাজেই এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে অনেক টেক্সটাই নকল করা হয়নি, এবং সেগুলো চিরতরে হারিয়ে গেছে। যদিও, অন্তত, আমাদের কাছে সেই বইগুলো আছে যেগুলো খোদ রোমকরা সেরা আর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করত, কারণ - স্পষ্টতই — সেগুলোই সবার আগে নকল করা হয়েছিল।
পাণ্ডুলিপির খুব বেশি আমাদের সংগ্রহে নেই। কিছু আছে পঞ্চম শতকের ,যার মধ্যে দুটিতেই রয়েছে ভার্যিলের মহাকাব্য ঈনীড,  কিন্তু বেশিরভাগই হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। আমাদের কাছে যা আছে তা হলো সে-সব নকলের পরবর্তীকালের নকল। শার্লামেন ও তার সমসাময়িক কিছু মানুষের উদ্যোগের কারণে নবম শতকের ধ্রুপদী লেখকদের বেশ কয়েকজনের কাজ সংরক্ষণ করা গেছে। অন্যক্ষেত্রে, সবচাইতে পুরানো বিদ্যমান পাণ্ডুলিপিটি পঞ্চদশ শতকের, সেই সময়ের যখন ধ্রুপদী যুগের ব্যাপারে রেনেসাঁ যুগের উৎসাহী মানুষেরা সুসম্বদ্ধভাবে পুরানো পাণ্ডুলিপির সন্ধানে ব্যাপৃত হয়ে সেগুলো নকল করিয়েছিলেন।
কেউ একটা চৰ্মপটের পাণ্ডুলিপি তৈরি করার মানেই এই নয় যে সেটা আজীবন টিকে থাকবে । বেশি ব্যবহারে সেটা জীৰ্ণ হয়ে যেতে পারে, বৃষ্টি ঝড় বা স্যাঁতসেঁতে অবস্থার জন্য ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। আবার, আগুনও আমাদের বঞ্চিত করেছে। অনেক পাণ্ডুলিপি থেকে। কখনো কখনো সে-সবের মালিকরা সেগুলোকে বইয়ের আবরণ বা মলাট হিসেবে বা অন্য কোনো দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করেছেন। কখনো কখনো আবার লোকে কোনো চাছনি বা রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে পাণ্ডুলিপির পাতার সব লেখা মুছে ফেলে তার ওপরে নতুন কিছু লিখেছে। এরককম পুনঃব্যবহৃত পাণ্ডুলিপিকে ইংরেজিতে palimpsest বলে।
এসব ক্ষেত্রে, গোড়াতে কি লেখা ছিল সেটা মাঝে মাঝে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। হয়, এবং এভাবেই বেশ কিছু প্ৰাচীন টেক্সট পুনরাবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। অবশ্য, প্রাচীনতম পাণ্ডুলিপিগুলো সংরক্ষণ করা হয়নি বললেই চলে, কিন্তু তারপরেও কোনো না কোনোভাবে এখনো অনেক লাতিন পাণ্ডুলিপি রয়েছে আমাদের কাছে। আমার জানামতে কেউই সেগুলোর সংখ্যা নিরূপণ করার চেষ্টা করেননি, কিন্তু তারপরও বলা যায় যে সংখ্যাটা বেশ কয়েক লাখ হবে। আজ সেগুলোর বেশিরভাগই বিভিন্ন গ্রন্থগার বা মহাফেজখানায় রয়েছে।
ভ্যাটিকানের গ্রন্থাগারে, বা ব্রিটিশ গ্রন্থাগারে, বা প্যারিসের বিবলিওথেক ন্যাশনালের মতো জায়গায় বেশ কয়েক হাজারের মতো পাণ্ডুলিপির বিশাল সংগ্রহ রয়েছে। এ সবের বেশির ভাগই গির্জার লিপিকরেরা বিভিন্ন মঠে তৈরি করেছিলেন।
চর্মপটে উত্তরণের ব্যাপারটা প্ৰায় সেই সময়ে ঘটেছিল। যখন খৃষ্টধর্ম রোমক সাম্রাজ্যে নিজের স্থান করে নিয়েছিল এবং যতদূর মনে হয়, মূলত খৃষ্টানরাই নতুন কৌশলগুলো ব্যবহার করেছিল,একেবারে প্রথম থেকেই। কাজেই এটা কোনো আপতিক ঘটনা নয়। যে, যে-সব পাণ্ডুলিপি টিকে গেছে তার সিংহভাগই সে-সব বইপত্রের নকল বা অনুলিপি যেগুলো খৃষ্ট সম্প্রদায়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় বাইবেলের অন্তর্গত প্রার্থনা-সংগীত (the psalter), স্তোত্র সংগ্ৰহ, ইত্যাদি। অতি অবশ্যই সেখানে সম্পূর্ণ বাইবেল ছিল, ছিল বাইবেলের নানান অধ্যায় বা পর্বের টীকাভাষ্য, গির্জার ফাদারদের লেখা, আর অন্যান্য খৃষ্টীয় রচনা।
কিন্তু লাতিনের অন্যান্য যত নমুনা আমরা পেয়েছি।উৎকীর্ণ লিপিগুলো ছাড়া — সেই প্রাচীনতম কাল থেকে একেবারে ছাপাখানা আবিষ্কার হওয়া পর্যন্ত, সেগুলো আমরা খৃষ্টীয় বা অথুষ্টীয় নানান পাণ্ডুলিপি থেকেই পেয়েছি, এবং কেউ হয়তো সংগত কারণেই প্রশ্ন করতে পারেন যে, কোনোভাবেই খৃষ্টধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন কিছুর নকল তৈরি করার কোনো দায় সন্ন্যাসীদের ছিল কিনা। এ-প্রশ্নের জবাব এই যে, প্রাচীন যুগের শেষ দিকে আশ্রমিক প্রথা শুরুর সময় থেকে সচেতনভাবেই করা হয়েছে কাজটা। আমরা আগেই দেখেছি, কাসিওদোরাস ও অন্যান্য যারা মঠগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁরা প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের, বিশেষ ক’রে লিখিত সাহিত্যের কিছু অংশের দায়িত্বভার নিয়ে সেটার খানিকটা পরবতী কালের কাছে পৌছে দেয়ার কাজটিকে খৃষ্টানদের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। তাছাড়া, পাণ্ডুলিপির নকল তৈরি করাটা সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের জন্য একটা উপযুক্ত কাজ হিসেবেও বিবেচনা করা হতো।
ভালো ভালো মঠে একটা scriptorium’ বা লেখার ঘর থাকতই সবসময়, যেখানে সম্প্রদায়টির কিছু সদস্যকে সেই মঠের নিজস্ব বা অন্য কোথাও থেকে ধার করে আনা পাণ্ডুলিপি নকল করার কাজে নিরত রাখা হতো।
নিজস্ব বা তৈরি-করা পাণ্ডুলিপির সংখ্যা অবশ্যই মঠভেদে ভিন্ন হতো, কিন্তু মোটের ওপর একটা বড়সড় শিল্প ছিল সেটা, কারণ মঠ ছিল শত শত। টেক্সট বাছাইয়ের কাজটা সম্ভবত আপতিক-ই ছিল প্রায় সব সময়, অন্তত কিছুটা হলেও, কারণ যা হাতের কাছে পাওয়া গিয়েছিল বা জোগাড় করা গিয়েছিল সেগুলোরই নকল করিয়ে রেখেছিল মঠগুলো। সে যা-ই হোক, মাদ্দো কথা হলো, প্রাক-খুষ্টীয় যুগের একটা যথেষ্ট ভালো বারোয়ারি সংগ্ৰহ সংরক্ষিত রয়েছে আজ আমাদের জন্য।
  লিভির রোমের ইতিহাস, যার মূল ১৪২টি বইয়ের মধ্যে মাত্র ৩৫টি পাওয়া গেছে। অন্যদিকে, খৃষ্টান লেখকদের লেখা বরং ব্যাপকভাবে নকল করা হয়েছে। যেমন, চার্চ ফাদার অগাস্তিন ও জেরোমে ছিলেন অবিশ্বাস্য রকমের বহুপ্রজ, এবং তাদের রচনার প্রায় প্রতিটি লাইনই টিকে গেছে।
গোটা মধ্যযুগ জুড়েই খৃষ্টীয় অখুষ্টীয় দুই বিষয়েই লোকে লাতিন ভাষায় লিখে গেছে। কাজেই, নকলযোগ্য বই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বেড়েই চলেছিল অবিরত। স্পষ্টতই, এর মধ্যে একটা বড় অংশ বেমালুম উধাও হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু অনেকগুলোই তা হয়নি, এবং আজ আমাদের হাতে যে-সব লাতিন টেক্সট আছে তার অনেক বড় একটা অংশ প্রাচীন যুগের পর লেখা হয়েছে।
সেই সময় থেকে মুদ্রণের যুগ শুরু হওয়ার আগের প্রায় সব কিছু আমাদের কাছে পৌছে দেবার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা ছিল সন্ন্যাসী আর সন্ন্যাসিনীদের যারা পাণ্ডুলিপিগুলো নকল করার কাজটি করেছেন। দীর্ঘদিন তাঁরা চর্মাপটে লিখেছেন, কিন্তু চতুর্থ শতক থেকে কাগজের ব্যবহার প্রচলিত হলো। এটা বেশ পুরনো একটি কৌশল, যা যিশু খৃষ্টের জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই চীনে আবিষ্কৃত হয়েছিল। মুসলিম জগতে কাগজের ব্যবহার চলে আসছে সেই অষ্টম শতক থেকে, কিন্তু ইউরোপে, আরো সঠিকভাবে বললে স্পেনে সেটা তৈরি হতে শুরু করে কেবলই ত্ৰয়োদশ শতকে। প্ৰায় সেই সময়েই শিক্ষা ও লেখালেখি সংক্রান্ত সব বিষয়ের ওপর থেকে গির্জা তার নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে। কাগজ যেহেতু চৰ্মপটের চাইতে সস্তা। তাই লোকজনের পক্ষে আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী উপায়ে টেক্সটগুলোর নিজের নকল নিজেই করা বা নিজে নিজেই টেক্সট লেখা সম্ভব হলো।
চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকের এমনকি আরো পরের এমন বহু টেক্সট রয়েছে। গ্রন্থনির্মাণের প্রধান ভূমিকা থেকে গির্জাকে প্রতিস্থাপিত করার জন্য কেবল মুদ্রণ শিল্পই যে দায়ী ছিল তা নয়। পঞ্চদশ শতকের শেষ দিকে ছাপাখানা যখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে, মঠগুলো ততদিনে এই বাজারে তার অগ্রগণ্য অবস্থান হারিয়ে ফেলেছিল।
তারপরেও, প্রায় এক সহস্রাব্দ ধরে, প্রাচীন যুগের সংস্কৃতি প্রচার করার দায়িত্ব বিভিন্ন মঠের স্ক্রিপ্টোরিয়াম বা লেখার ঘরগুলোর ওপর বর্তেছিল প্ৰায় নিরঙ্কুশভাবেই। সেখানে যে-সব পাণ্ডুলিপি তৈরি হতো। সেগুলো সব সময় সহজপাঠ্য ছিল না। সমস্যাটা যে হাতের লেখারই ছিল সাধারণত তা নয়, যদিও অবশ্যই লিপিকর, কাল, এবং স্থানভেদে প্রায়ই লিখনশৈলীর তফাত হতো। হস্তরেখা পরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞরা একটি পাণ্ডুলিপি তৈরির স্থান ও কাল সম্পর্কে মূল্যবান সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারেন। এই বিদ্যাটিকে palaeography বলা হয়; লাতিন টেক্স নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের প্রত্যেকের কাছে  এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
বইঃ লাতিন ভাষার কথা
লেখকঃ তরে ইয়নসন
অনুবাদঃ জি এইচ হাবিব
-----------------

ক্রীতদাস ইতিহাসের অন্ধকার দিক

$
0
0

ক্রীতদাস ইতিহাসের অন্ধকার দিক

প্রাচীন পৃথিবীতে কৃষিভিত্তিক বহু সমাজেই ক্রীতদাস প্রথার চল ছিল। তবে এ ব্যাপারে সবচেয়ে এগিয়ে ছিল গ্ৰীস এবং রোম। পশ্চিমি পন্ডিতদের চোখে গ্ৰীস হল ইউরোপের বিশুদ্ধ শৈশব। রোম তার উত্তরাধিকারী। প্রাচীন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের এই দুই সভ্যতা (গ্ৰীক ও রোমান) নানা কারণে উত্তরকালের কাছে মস্ত বড় অনুপ্রেরণা। সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন ভাবনা নানা ক্ষেত্রে এদের
উত্তরাধিকার। যাঁরা মনে করেন সব মিলিয়ে এই দুই ধ্রুপদী সভ্যতার উৎকর্ষ অতুলনীয় তাঁরা একটি জায়গায় এসে হোচাট খান------গ্রীস ও রোমের ক্রীতদাসপ্রথা।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, প্রাচীন গ্ৰীস এবং রোমে দাসপ্রথা অভূতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছেছিল। দুই সভ্যতাই ছিল ভীষণভাবে দাস-নির্ভর। অন্য কোনো প্ৰাক-শিল্প সভ্যতার এতখানি দাস-নির্ভরতা ছিল না। তাই সে কালের গ্ৰীক এবং রোমান সাহিত্যে ক্রীতদাসের প্রভূত উল্লেখ পাওয়া যায়। ধ্রুপদী যুগের গুণগ্ৰাহীদের কাছে বিষয়টি অস্বস্তিকর। কেননা দাস ব্যবস্থার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে অন্তহীন শোষণ আর অত্যাচারের কাহিনি। একদিকে মুষ্টিমেয় ধন্যবান মানুষের প্রভুত্ব, অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠের অসহায় বশ্যতা। সামাজিক পরিচয়ে এই ধনবান শ্রেণি হল স্বাধীন নাগরিক। অন্যান্যদের মধ্যে একটি বড় অংশ হয় ক্রীতদাস নইলে ভূমিদাস।
উভয়ের মধ্যে অবশ্য যথেষ্ট পার্থক্য ছিল। এমন এক অমানবিক প্রতিষ্ঠানের উপর যে সভ্যতা দাঁড়িয়ে ছিল সেই সভ্যতার নান্দনিক উৎকর্ষে একটু কালির ছিটে লাগে বই কি!
মার্কসবাদী পন্ডিতরা বলে থাকেন, প্রাচীন গ্রীকদের অসামান্য সব কীর্তি যে সম্ভব হয়েছিল তার একটা কারণ হল, গ্রীকদের সভ্যতা গড়ে উঠেছিল অনেকটাই দাস ভিত্তির উপর।
গ্ৰীক সভ্যতার সূচনা যিশুর জন্মের আনুমানিক দুহাজার বছর আগে মাইনোয়ান যুগে। প্রায় ছ'শো বছরের মাইনোয়ান সভ্যতার পর চলে আনুমানিক দুশো বছরের মাইসিনিয় সভ্যতা। মাইনোয়ান এবং মাইসিনিয়া গ্ৰীসে সম্ভবত ক্রীতদাস ছিল। তবে তখন ক্রীতদাস বলতে কি বোঝাতো তা জানার মত তথ্য-প্রমাণ ঐতিহাসিকদের হাতে নেই। হামোরের দুই মহাকাব্য ইলিয়াড এবং ওডিসি-র রচনাকাল আনুমানিক ৭৫০-৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এই দুই মহাকাব্যে দাসত্ব এবং দাসপ্রথার টুকরো টুকরো ছবি পাওয়া যায়। হামোর বা হেসিয়ডের রচনা পড়লে বোঝা যায় গ্ৰীকরা কি অনিবাৰ্যভাবে এবং নিদ্বিধায় দাসপ্রথাকে মানুষের জীবনের একটি স্বাভাবিক ঘটনা বলে ধরে নিত। রোমান সভ্যতারও অনুষঙ্গ ছিল দাসব্যবস্থা। রোমান ঐতিহ্য অনুযায়ী রোমিউলাস ৭৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোম নগরীর পত্তন করেন। আধুনিক প্রত্নতত্ববিদরা এই সাবেক তথ্য মেনে নিয়েছেন। বলা যেতে পারে, রোমানরা শিল্প, স্থাপত্য,সাহিত্য, এবং দর্শনে গ্রীকদের যোগ্য উত্তরসূরী। যুদ্ধ এবং শান্তি উভয় ক্ষেত্রেই তাদের বিপুল উপস্থিতি। একই সঙ্গে দাসপ্রথার ঐতিহ্যটিও তাদের উত্তরাধিকার। আমাদের মূল আলোচ্য হল দাস বিদ্রোহ এবং এই আলোচনার সময়কাল মূলত যিশুর জন্মের আগের দুটি শতক।
হামোরের যুগে গ্রীকরা ক্রীতদাস বা Slave বোঝানোর জন্য যে সব শব্দ ব্যবহার করতেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল অ্যানড্রোপোডন, ইংরাজিতে যার অর্থ Chattel Slave. অ্যানড্রোপোডন কথাটির মানে মনুষ্যপদবিশিষ্ট জীব বা man-footed creature অর্থাৎ মানুষ। শব্দটি এসেছিল টেট্রাপোডা শব্দের উপমা হিসাবে। টেট্রাপোডার অর্থ চতুষ্পদী গবাদি প্রাণি (four-footed cattle)। গ্রীসে দাসপ্রথা বলতে যা বোঝানো হত তা আসলে Chattel slavery. ক্রীতদাস হল সেই মানুষ যে আইন ও সমাজের চোখে অন্য একজন মানুষের একটি Chattel বা অধিকার। পলিবিয়াস লিখেছেন, জীবনের অত্যাবশ্যক প্রয়োজন হল গবাদি পশু আর ক্রীতদাস। বাস্তবিক ক্রীতদাসরা ছিল জীবনের যাবতীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত প্ৰান্তিক মানুষ, অ্যারিস্টটলের ভাষায়, জীবন্ত যন্ত্র।
বিশিষ্ট ইংরেজ মার্কসবাদী জিওফ্রে সা ক্রোয়া প্রাচীন গ্রীসের পরাধীন শ্রম বা unfree labour-কে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন।
প্রথমটি দাসপ্রথা
দ্বিতীয়টি ভূমিদাস প্রথা এবং
তৃতীয়টি ঋণজনিত দাসত্ব বন্ধন
এথেন্স রাষ্ট্রে রাষ্ট্রনায়ক সোলোনের আমলে যে প্রথাটির অবসান ঘটানো হয়েছিল। সা ক্রোয়ার মতে, গ্ৰীক এবং রোমান ইতিহাসের সেরা সময়গুলিতে ক্রীতদাসপ্ৰথাইছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরাধীন শ্রম। সেসময় ভূমিদাস প্ৰথা আদৌ ক্রীতদাসপ্রথার মত এতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।
স্বভাবতই প্ৰাচীন গ্রীস এবং রোমের সমাজ ও অর্থনীতিতে ক্রীতদাসরা ঠিক কি ভূমিকা পালন করত সেই প্রশ্নে ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে ভয়ঙ্কর বিতর্ক আছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে পশ্চিমী দুনিয়ায় শুরু হয়। দাসপ্রথা বিরোধী আন্দোলন। স্বভাবতই প্রাচীন গ্ৰীস ও রোমের, বিশেষ করে গ্ৰীসের দাসব্যবস্থা নিয়ে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য শোনা যায়। অনেকে বলেন, দাসপ্রথা-বিরোধী ভাবনা সর্বপ্রথম প্রাচীন পৃথিবীতেই গড়ে উঠেছিল। এদের মতে, কিছু কিছু গ্ৰীক সফিস্ট এবং রোমান জুরিস্ট যখন বলেন যে, দাসপ্রথা কোনো স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান নয়, বরং একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান, তখন তারা আসলে দাসপ্রথার নিন্দা করার জন্যই তা বলেন।
অন্য অনেকের বক্তব্য হল, প্রাচীন সভ্যতার মধ্যে থেকে উঠে আসা দুই মহান নৈতিক শক্তি — স্টোইক দর্শন (দার্শনিক জেনো প্রবর্তিত বৈরাগ্যদর্শন) এবং
**খ্রিস্টধর্ম— দাসপ্রথাকে পরিমার্জিত ক’রে এর মানবিকীকরণ ঘটিয়েছিল। অন্যদের মতে, দাসপ্রথাকে নৈতিক নয়, বরং অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে।**
এরা মনে করেন প্রাচীন পৃথিবী যে অর্থনীতিতে পুঁজিবাদী উন্নয়ন ঘটাতে পারল না তার জন্য দাসপ্ৰথাই দায়ী। এদের মতে, দাসব্যবস্থা শোষণের এমন এক পদ্ধতি যা মানব সভ্যতার বিকাশের পথে একটি বিশেষ পর্যায়কে চিহ্নিত করে। পরে এই ব্যবস্থাকে অতিক্রম করে এসেছিল শোষণের অন্য দুই পর্যায়। — সামন্ততন্ত্র এবং পুঁজিবাদ। মার্কস এই শেষ বক্তব্যটি গ্রহণ করেছিলেন। দাসপ্রথাকে। তিনি মনে করতেন প্ৰাথমিকভাবে একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। মার্কসের এই অবস্থান পরবর্তীকালে পুব ও পশ্চিমে মার্কসবাদী ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিপুল গবেষণা ও লেখালেখির সূচনা করেছে।
১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল মার্কস এবং এঙ্গেলস-এর কমিউনিস্ট ইস্তেহার। ঘোষিত হয়েছিল, আজ পর্যন্ত সমস্ত সমাজের ইতিহাস হল শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস। ফলে প্ৰভু ও ক্রীতদাস, এলিট ও নিম্নবর্গ, গিন্দ্রপ্রধান ও জানিম্যান — এক কথায় শোষক ও শোষিত পরস্পরের বিরুদ্ধে চিরকালীন সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ধ্রুপদী যুগের দাসপ্রথা মার্কসবাদী এবং অমার্কসবাদীর লড়াই-এর ক্ষেত্র হয়ে আছে।
ক্রীতদাসরা ছিল প্ৰভুদের একচেটিয়া সম্পত্তি। প্রভুর উপরে ক্রীতদাসের সামগ্রিক নির্ভরতা অনেকটা পিতার উপরে পুত্রের নির্ভরতার মত। প্রাচীন পৃথিবীতে প্ৰভু নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের জন্য বাস্তবিকই ক্রীতদাসকে ‘সন্তান” বলে সম্বোধন করতেন (গ্ৰীক ভাষায় বলা হত “পাই”, লাতিনে “পুয়ের”)।
তবে পার্থক্যটা হল, একজন সন্তান বড় হয়ে উঠত ভবিষ্যতে প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক হয়ে ওঠার জন্য। আর ক্রীতদাস এমন কিছুর কথা কল্পনাই করতে পারত না। ভবিষ্যতে তার সামাজিক অবস্থানে কোনো পরিবর্তনের প্রত্যাশাও সে করত না। বাস্তবে, খুব অল্প কিছু গ্ৰীক এবং রোমান ক্রীতদাসই তাদের স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছিল। প্রভুর উপর তার ক্রীতদাসের যে নৈতিক দাবিই থাক না কেন, তা দিয়ে তার চূড়ান্ত অধিকারহীনতার কোনো পরিবর্তন ঘটত না। আগেই বলেছি, দাস ছিল তার প্রভুর সম্পত্তি এবং একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে দাসপ্রথার মধ্যে সীমাহীন জোরজুলুম এবং শোষণের অনুমোদন ছিল।
প্রাচীন গ্রীসের এক প্রধান রাষ্ট্র স্পার্টায় দাসব্যবস্থার চেহারা ও চরিত্র ছিল আলাদা। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গ্ৰীসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত রাষ্ট্র এথেন্স ছিল গণতান্ত্রিক। কিন্তু স্পার্টায় কোনোদিন গণতন্ত্র ছিল না। স্পার্ট ছিল অভিজাত, অলিগার্কিক রাষ্ট্র।
খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকে স্পার্টানরা মেসেনিয়া অঞ্চলটি জয় ক’রে নেওয়ার পর সেখানকার বিজিত গোষ্ঠীগুলির উপর বিপুল অর্থনৈতিক বোঝা চাপানো হয়। ঐ সব গোষ্ঠীকে তাদের কৃষি উৎপাদনের অর্ধেক ছেড়ে দিতে হয়। এদের পরিচয় হয় হেলট বা ভূমিদাস। গ্ৰীসের অল্প কয়েকটি রাষ্ট্রেই কেবল ভূমিদাসপ্রথা চালু ছিল। স্পার্টা এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখানকার হেলটরা এথেন্সের ক্রীতদাসদের মত ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না। ক্রীতদাসদের মত এদের বিক্রি করা যেত না যেহেতু এরা যে জমি চাষ করত সেই জমি ছেড়ে কখনো অন্যত্র যেতে পারত না। তাই ভূমিদাসরা নিজেদের পরিবারিক গোষ্ঠীর মধ্যেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারত। এই সুযোগ ক্রমাগত বিক্রি হয়ে যাওয়ার ফলে ক্রীতদাসদের জুটত না। জিওফ্রে সা ক্রোয়া স্পার্টার হেলটদের “State Serf” বা রাষ্ট্ৰীয় ভূমিদাস বলেছেন।
এই হেলটদের উপর স্পার্টানদের বর্বর অত্যাচারের বহু প্রমাণ আছে। এই প্রসঙ্গে একটি চালু তথ্য হল, প্রতি বছর স্পার্টার শাসকরা রীতিমত নিয়ম ক’রে হেলটদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোযণা করত। খোদ অ্যারিস্টটল জানিয়েছেন যে, প্রত্যেক বছর ইফর’ নামে পরিচিত স্পার্টার মুখ্য ম্যাজিস্টেটরা হেলটদের রাষ্ট্রের শত্রু (গ্ৰীক ভাষায় পোলেমিয়ায় polemioi) বলে ঘোষণা করতেন।
স্পার্টাতে কেবলমাত্র আইনসঙ্গতভাবেই কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যেত বা কারুর মৃত্যু ঘটানো যেত। তা নাহলে ধর্মীয় পবিত্রতা ক্ষুন্ন হত। একমাত্র পোলেমিয়ায় বা রাষ্ট্রের শক্ৰদের ইচ্ছামত হত্যা করা যেত। তাই হেলটদের জন্য এই ঘোষণা। এইভাবে নিজেদেরই শ্রমশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করাটা এতটাই বিরল একটি ঘটনা যে তা থেকে স্পার্টানদের সঙ্গে তাদের হেলটদের সম্পর্ককে গ্ৰীক দুনিয়ায় একটি আশ্চর্য বিষয় হিসাবে বর্ণনা করা যায়।
যেহেতু সার্বিকভাবে স্পার্টান রাষ্ট্রই ছিল হেলটদের প্রভু তাই হেলটদের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ও পীড়নও ছিল সীমাহীন।
পল কাৰ্টলেজ লিখেছেন, স্পার্টান রাষ্ট্র হেলটদের শ্রমকে নিঙড়ে নিয়ে বিপুল উন্নতি করেছিল। হেলটরা ছিল প্রধানত মেসেনিয়া এবং ল্যাকেনিয়ার বাসিন্দা, স্পার্টানরা যাদের পদানত করেছিল। মেসেনিয়রাই ছিল দলে ভারী। কার্টলেজ মেসেনিয় হেলটদের অর্থনৈতিকভাবে একটি সুস্পষ্ট শ্রেণি বলে চিহ্নিত করেছেন। র্তার মতে, মেসেনিয় হেলটদের ক্রমাগত বিদ্রোহ শ্রেণিসংগ্রাম ছাড়া কিছু নয় যার লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রের ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়া। বাস্তবে অবশ্য ঠিক এটাই ঘটেছিল। হেলটরা স্পার্টানদের বিরুদ্ধে সুযোগ পেলেই বিদ্রোহ করত। তারা তাদের প্রভুদের প্রচন্ড ঘূণা করত। অন্যদিকে স্পার্টানরাও সব সময় হেলট বিদ্রোহের আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত থাকত। বিশেষ ক’রে মেসেনিয়ার হেলটদের তারা কখনো বিশ্বাস করত না। থুকিডডিস জানিয়েছেন, স্পার্টান রাষ্ট্রের হয়ে নানা যুদ্ধবিগ্রহে হেলটরা যথেষ্ট বীরত্ব দেখালেও আখেরে কিন্তু তাদের কোনো লাভ হত। না। তিনি লিখেছেন, ৪২৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে স্পার্টান রাষ্ট্র দু'হাজার দুঃসাহসী হেলট যোদ্ধাকে পুরস্কার স্বরূপ স্বাধীনতা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিল। এই প্রতিশ্রুতি রাখা হয় নি। উল্টে এদের মধ্যে অনেককেই রাতের অন্ধকারে হত্যা করা হয়েছিল। হেলট বিদ্রোহ তাই খুব স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ছিল।
এথেন্স নিঃসন্দেহে সেকালের মাপকাঠিতে বুজোঁয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল। তার ছিল বিরাট নৌ-বল, বাণিজ্য-বল এবং সাম্রাজ্য-বল। খ্রিস্ট পূর্ব পঞ্চম শতকে তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও ছিল চোখ  ধাঁধানো। ক্রীতদাসদের ব্যাপারে অবশ্য এথেন্সও কম উৎপীড়ক ছিল না। এথেনীয় লেখক জেনোফন লিখেছেন, কাজ, খাবার আর শাস্তি - এই তিনে মিলে দাসের জীবন। বাস্তবিক গ্ৰীক সাহিত্য থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, ক্রীতদাসদের চাবাঁকানো, তাদের উপর অত্যাচার করার ঘটনার কোনো অভাব ছিল না।
প্রয়োজনে মানসিক পীড়নও চলত। ক্রীতদাসের বরাদ্দ কাজ তাকে করতেই হত। সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, মামলা মোকদ্দমার বিচারের সময় সাক্ষ্য-প্রমাণ ও তথ্য বের করার জন্য গ্রীকরা রীতিমত নিয়ম ক’রে ক্রীতদাসদের উপর অত্যাচার করত। গ্রীকদের বিশ্বাস ছিল। এইভাবে অত্যাচার ক’রে যে তথ্য মিলত স্বাধীন মানুষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের তুলনায় তা অনেক বেশি কার্যকরী। কেননা স্বাধীন মানুষের উপর অত্যাচার চালানো যেত না। এই ধরনের অত্যাচারকে গ্ৰীক ভাষায় বলা হত ব্যাসানস (basanos)। আধুনিক গবেষকরা আরো দেখিয়েছেন, ক্রীতদাসদের কাছ থেকে এজাহার নেওয়ার জন্য বিশেষ আইন ছিল।

এই আইন অনুযায়ী, ক্রীতদাসরা আদালতে হাজির হতে পারত না। কিন্তু অত্যাচার ক’রে একজন ক্রীতদাস বা ক্রীতদাসীর কাছ থেকে যে বিবৃতি আদায় করা হত তা দিব্যি সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসাবে আদালতে পেশ করা চলত।
রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন আইন এবং রাষ্ট্রীয় সনদ থেকে জানা যায়, কোনো ক্রীতদাস কখনো তার প্রভুর বিরুদ্ধে অভিযোগ বা নালিশ করার চেষ্টা করলে তা আন্দীে শোনা হত না। বরং তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হত। কদাচিৎ খুব ব্যতিক্রমী কোনো পরিস্থিতিতে হয়ত আদালত এমন অভিযোগ শুনতে প্ৰস্তুত থাকত। যেমন, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা শাস্ত্রীয় কদাচারের মত ঘটনা। একবার খোদ রোমান সম্রাট অগাস্টাস মনে করেন কিছু নাগরিকের রাষ্ট্রদ্রোহিতা সম্পর্কে তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার জন্য তাদের দাসদের জিজ্ঞাসাবাদ করাটা জরুরি। তিনি ঐ ক্রীতদাসদের স্বয়ংক্রিয় ক’রে নেন। রোমান আইনে অবশ্য এটা বলা হয়েছিল যে শেষ পন্থী হিসাবে কোনো কিছু প্রমাণের জন্য দাসদের উপর অত্যাচার করা যেতে পারে।
আধুনিক মাপকাঠিতে বিচার করলে প্রাচীন পৃথিবীতে বর্বরতার মাত্রা নিঃসন্দেহে খুব বেশি ছিল। আসলে গ্ৰীস এবং রোমে ক্রীতদাস ছিল প্ৰাস্তিক মানুষ। সে অত্যাচার ছাড়া সত্য বলবে এ কথা কেউ বিশ্বাস করত না। স্বাধীন মানুষের জন্য যদি প্রয়োজন হয় যুক্তিবাদী আচরণের, তাহলে ক্রীতদাসের জন্য প্রয়োজন হিংস্রতার।
নাট্যকার অ্যারিস্টোফানিস ঠাট্টা ক’রে বলেছিলেন, পাইস (pais) শব্দটি এসেছে পেইন (paiein) থেকে। প্রসঙ্গত, পটুইস মানে ক্রীতদাস বা শিশু। আর পেইন মানে প্রহার। রোমান লেখকরা একটি গল্প শুনিয়েছেন।
**একবার ভিডিয়াস পোলিও নামে এক ধনী রোমান নাগরিক সম্রাট অগাস্টাসকে নৈশভোজে আপ্যায়িত করেন। ভোজ চলাকালে বয়সে প্রায় বালক এক ক্রীতদাস একটি কাচের দামী পানিপাত্র ভেঙে ফেলে। ক্রুদ্ধ পোলিও বালকটিকে একটি মাছের চৌবাচ্চায় নিক্ষেপ করার আদেশ দেন। ঐ চৌবাচ্চায় ছিল হিংস্র সব মাছ যারা বালকটিকে খেয়ে ফেলত। দাসটি অবশ্য প্ৰাণে বেঁচে গিয়েছিল সম্রাট তৎক্ষণাৎ তাকে মুক্ত বলে ঘোষণা করায়।

**দ্বিতীয় শতাব্দীর গ্রিক চিকিৎসক গ্যালেন জানাচ্ছেন, তাকে তাঁর বহু বড়লোক বন্ধুবান্ধবের চিকিৎসা করতে হয়েছিল। কেননা এরা এদের দাসদের মারধোর করতে গিয়ে নিজেরাও অল্পবিস্তর আহত হত। আর এই ধরনের অত্যাচারের জন্য প্রভুরা কারুর কাছে কৈফিয়ত দিত না। এ হেন অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাসেরা যে সুযোগ পেলেই বিদ্রোহ করবে তাতে আর আশ্চৰ্যকি!
বইঃ দাস বিদ্রোহের কাহিনী
লেখকঃ সুপ্রতিম দাশ

সক্রেটিস এর বিচার ও মৃত্যু

$
0
0

সক্রেটিস এর বিচার ও মৃত্যু

সক্রেটিস দেখতে মোটেও সুদৰ্শন ছিলেন না । প্রাচীন সাহিত্য ও দর্শনে তাঁর সম্পর্কে যেটুকু জানা যায়, আর প্রাচীন ভাস্কর্য ও চিত্র থেকে তাঁর চেহারার যে আভাস মেলে-তা থেকে এমন ধারণাই করতে হয় । গোলগাল, কিছুটা মোটাসোটা টাক-মাথা , সেইসঙ্গে থ্যাবড়া নাক । মোটের ওপর চেহারাটা তার আকর্ষণীয় ছিল না একেবারেই । তার পরও, সেই সময়ের এথেন্সের তরুণ-যুবকেরা এসে ভিড় জমাচ্ছিল তার চারপাশে, পেতে চাইছিল তাঁর সান্নিধ্য, শুনতে চাইছিল তাঁর কথা ।
সমাজের নানা শ্রেণী থেকে আসছিল এ সকল তরুণ । এদের মধ্যে ছিলেন প্লেটো”৩ ও অ্যালসিবিয়াডেসের মতো ধনী-বংশের ছেলেরা। সক্রেটিসের মুখে এথেনীয় গণতন্ত্রের ব্যঙ্গাত্মক বিশ্লেষণ শুনে মজা পেতেন এরা । ছিলেন অ্যান্টিসথেনেসের  মতো সমাজতন্ত্রী; সক্রেটিসের দারিদ্র্যাক্লিষ্ট জীবনই আকর্ষণ করে এনেছিল একে ৷ ছিলেন, এমনকি অ্যারিস্টিপ্পাসের  মতো সব কিছুতে বিশ্বাস হারানো এক যুবক।সমাজকে পুরোপুরি ঢেলে সাজানোয় বিশ্বাস করতেন ইনি, স্বপ্ন দেখতেন এমন এক পৃথিবীর যেখানে সব মানুষই হয়ে উঠবে সক্রেটিসের মতো মুক্তমনা ।
কোন আকর্ষণে সক্রেটিসের কাছে ছুটে আসছিল এ সকল তরুণযুবক?
মূল একটি কারণ হয়তো ছিল-অসাধারণ একজন দার্শনিক হবার পাশাপাশি, মানুষ হিসেবেও সক্রেটিস ছিলেন অনন্য । অত্যন্ত সহজ-সরল, সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। তিনি। সাহসীও ছিলেন খুব । নিজের জীবন বিপন্ন করে যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন বঁচিয়েছিলেন অ্যালসিবিয়াডেসের । আর, সক্রেটিসের অন্য যে বৈশিষ্ট্যটি মুগ্ধ করত তরুণদের, তা তার জ্ঞানের নম্রতা, তার নিরহংকারী বিনয় । নিজেকে কখনোই জ্ঞানী বলে দাবি করতেন না তিনি । বলা হয়ে থাকে, ডেলফি মন্দিরের ‘ওর্যাকল’ গ্রিকদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ হিসেবে ঘোষণা করেছিল সক্রেটিসের নাম । এ ঘোষণাকে, শেষপর্যন্ত, মেনে নিয়েছিলেন সক্রেটিস; কিন্তু, সেইসঙ্গে, বলেছিলেন এ কথাও
: ‘আমি একটা জিনিসই শুধু জানি, তা হচ্ছে-আমি কিছুই জানি না ’।
দর্শনের আরম্ভ সেখানেই, যেখান থেকে মানুষ প্রশ্ন করা শুরু করে । বিশেষ করে যখন সে প্রশ্ন করে তার নিজের বিশ্বাস, সংস্কার ও ধ্যান-ধারণাগুলোকে । এসব বিশ্বাস আর ধারণার আপাত অভ্রান্তির পেছনেই কখনো কখনো ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকে মানুষের নিজস্ব লোভ, নিজস্ব স্বার্থ। দর্শন কখনোই সত্য হয়ে ওঠে না যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ তার নিজের মনকে খতিয়ে না দেখে । যেমন বলেছিলেন সক্রেটিস : “নিজেকে জানো '**
এথেন্সের বাজারে, পথেঘাটে নানা মানুষকে, নানা সময়ে, আত্মসমীক্ষণে প্ররোচিত করতেন সক্রেটিস । শেখাতে চাইতেন- কীভাবে নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করতে হয় । কেউ যদি জোরালোভাবে ন্যায় ও অন্যায় বিষয়ে কথা বলত, নিরীহ গলায় জানতে চাইতেন- কাকে বলে “ন্যায়?
বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন প্রয়োজনে, মানুষ বিমূর্ত যে সকল ধারণাকে শব্দের মাধ্যমে প্ৰকাশ করে, নিশ্চিন্ত মনে ব্যবহার করে চলে-শব্দের আড়ালের ওই ধারণাগুলোকেই প্রশ্নের শরে বিদ্ধ করতে উদ্ধৃদ্ধ করতেন সক্রেটিস।
সম্মান কাকে বলে? মানবগুণ কাকে বলে? নীতি কী? মানবসত্তা কী? দেশপ্ৰেম কী? কেমন রাষ্ট্র চাই?
অবিরাম প্রশ্নের এই বাণে, একসময়, নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনলেন তিনি। যুদ্ধের সময় সেটা। রাষ্ট্রের যেকোনো রকম সমালোচনা করাই বিপজ্জনক । তার ওপর, যে-সময়ে গণতন্ত্রী শাসনব্যবস্থার নানা অসংগতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি। তরুণদের উদ্বুদ্ধ করছিলেন নিজেদের চিন্তায় ওইরকম অজস্র অসংগতিকে চিহ্নিত করতে, সেগুলো পরিহার করতে-সেই একই সময়ে, সম্ভ্রান্ত বংশের কিছু নেতা গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েমের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন ।
কারমিডেস, ক্রিটিয়াস, অ্যালসিবিয়াডেসের মতো, এদের কেউ কেউ ছিলেন সক্রেটিসের সরাসরি ছাত্র। যুদ্ধে স্পার্টার কাছে এথেন্সের পরাজয়ের পরপর, ক্ষমতার দখল নেন এরা । কিন্তু, সে অভু্যুত্থান সফল হতে পারেনি। মাত্র এক বছরের মাথায় পতন হয় “তিরিশ নেতার শাসন" । আর, এঁদের হটিয়ে, গণতন্ত্রপহীরা আবার যখন ক্ষমতায় ফেরেন, তখনই অভিযোগ আনা হয় সক্রেটিসের বিরুদ্ধে । সন্দেহ করা হয়, ব্যর্থ ওই অত্যুত্থানের মূল ইন্ধনদাতা তিনি। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে যে অভিযোগ আনা হয়, তাতে বলা হয় : সক্রেটিস অধাৰ্মিক; এথেন্সের প্রচলিত দেব-দেবীর প্রতি বিশ্বাস নেই তার; আর, এথেন্সের তরুণ প্ৰজন্মকে তার দর্শনচর্চার মাধ্যমে বিভ্রান্ত করছেন তিনি, ঠেলে দিচ্ছেন বিপথে । ফলে, কাঠগড়ায় দাড়াতে হয় সক্রেটিসকে । বিচারে মৃত্যুদণ্ড সাব্যস্ত হয় তাঁর ।
সক্রেটিসের বিচারের সময়ে প্লেটোর বয়স ছিল আটাশ । বিশ বছর বয়স থেকে, একটানা আট বছর, সক্রেটিসের ছাত্র ছিলেন প্লেটো।  আর, আরো ছোট বয়স হতেই চিনতেন পারিবারিক বন্ধু হিসেবে।
পরবর্তীতে, সক্রেটিসের এই বিচারের অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন প্লেটো তার অ্যাপলজি শীর্ষক ‘ডায়ালগ’টিতে । বিচারের পুরো সময়টাতেই বিচারস্থলে উপস্থিত ছিলেন তিনি। আর উপস্থিত ছিলেন সক্রেটিসের অন্তিম মুহূর্তেও : কারাগারের নিভৃত কক্ষে যখন হেমলকের পেয়ালা তুলে চুমুক দিচ্ছিলেন সক্রেটিস । হৃদয়বিদারক সেই অন্তিম দৃশ্যের বর্ণনা আছে প্লেটোর ফিডো” নামের ডায়ালগটিতে। এই ডায়ালগেরই শেষ বাক্যে মথিত হয়ে আছে পরম শ্ৰদ্ধেয় শিক্ষকের জীবনাবসানের পরপর এক ছাত্রের বুক চিরে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস : “এভাবেই চলে গেলেন আমাদের বন্ধু; সত্যিকারভাবে বলতে গেলে, তিনি ছিলেন আমার দেখা সকল মানুষের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী, সবচেয়ে ন্যায়বান-সবার চেয়ে সেরা মানুষ **

বইঃসক্রেটিসের আগে লেখকঃ আহমেদ খালেদ


মহানবী (সা)-এর সচিবালয়

$
0
0

মহানবী (সা)-এর সচিবালয়
পৃথিবীর সূচনা লগ্ন থেকে অদ্যাবদি এর রাষ্ট্র শাসকদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, যে সব গুণাবলীর ভিত্তিতে কোনো শাসককে আদর্শ হিসেবে পরিগণিত করা হয়, সেই নিরিখে বিশ্বের কোনো কোনো শাসক কোনো কোনো দেশে কিঞ্চিৎ কিংবা আংশিকভাবে সফল হলেও তাদের কেউ-ই আদর্শ রাষ্ট্র শাসক হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিতে পারেননি। যারা আদর্শ শাসকের কাতারেই আসতে পারেননি, তাদের কেউতো আদর্শ রাষ্ট্র নায়ক হবার প্রশ্নই অবান্তর।
এই ক্ষেত্রে এই ধরা পৃষ্ঠে একমাত্র ব্যতিক্রম শুধু একজনই। তিনি আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)। আদর্শ রাষ্ট্র শাসকের সবগুলো গুণাবলী শুধু তাঁর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য এবং এক অপরিহার্য বাস্তবতা। তাই তিনি একজন সফল শাসক এবং শাসকদের নায়ক। তাঁর রাষ্ট্র শাসনের সমালোচনার দুঃসাহস কেয়ামত পর্যন্ত কেউ করতে পারবেনা। তিনি সফল না হয়ে পারেন না, কারণ তিনি ছিলেন আল্লাহর ওহী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সূরা আহযাবের ২১নং আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা করেন, “নিশ্চয়ই রাসূলের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ।” ইহা তাঁর সার্বিক জীবন নিয়ে আল্লাহর সাক্ষ্য। আর রাষ্ট্র শাসন রাসূল (সা.) এর জীবনেরই একটি অধ্যায়। তথাপি আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক নিজেই ঘোষণা করেছেন, “আমার যুগ শ্রেষ্ঠ যুগ।” অতএব “আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক মুহাম্মদ (সাঃ)” এক সার্থক ও যথার্থ শিরোনাম।
* আদর্শ রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনঃ
পৃথিবীতে কোনো মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রশক্তি অপরিহার্য। পৃথিবীর স্রষ্টা আল্লাহ রাসূল (সঃ) কে আদর্শ রাষ্ট্র নায়ক হিসেবে অন্যান্য সকল মতাদর্শের উপর দ্বীন ইসলামকে বিজয়ী করার জন্য প্রেরণ করেছেন। আল্লাহর কুরআনের সূরা সফের ৯ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করেছেন, “তিনি আল্লাহ! তার রাসূলকে হেদায়েত ও সত্য দ্বীন সহকারে পাঠিয়েছেন যেনো, অন্যান্য সকল দ্বীনের উপর তাকে বিজয়ী করতে পারেন।” সূরা বনী ইসরাঈলের ৮০নং আয়াতে আল্লাহ তার রাসূলকে রাষ্ট্রশক্তি অর্জনের নসিহত দিয়েছেন। তাই আদর্শ রাষ্ট্র নায়ক জন্মভূমির কাফেরদের অত্যাচারে আল্লাহর হুকুমে প্রাচীন ইয়াসরেব নগরে হিজরত করেন। ইয়াসরেবকে “মদীনা” নামে তিনি আদর্শ রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। ৬২২-৬৩২ ঈসায়ী সাল পর্যন্ত আমৃত্যু ১০ বছর মদীনাকে কেন্দ্র করে জাজিরাতুল আরবে শাসন কার্য পরিচালনা করেন। তার এই ১০ বছরের সুশাসনই তাঁকে ইতিহাসে আদর্শ রাষ্ট্র নায়ক হিসেবে ক্বিয়ামত পর্যন্ত অনুসরণীয় করে তুলেছে।
* আদর্শ রাষ্ট্রের কর্মসূচীঃ
সূরা হজ্জের ৪১ নম্বর আয়াত থেকে (১) নামায প্রতিষ্ঠা করা (২) যাকাত আদায় করা (৩) সৎ কাজের আদেশ প্রদান (৪) অসৎ কাজের নিষেধ প্রদান।
সূরা বনী ইসরাঈলের ২৩-৩৭ আয়াত থেকে- (১) শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা (২) পিতা-মাতার প্রতি উত্তম আচরণ করা (৩) নিকটাত্মীয়, মিসকিন ও সম্বলহীন পথিকদের অধিকার প্রদান (৪) অপচয়-অপব্যয় না করা (৫) নিকটাত্মীয়, মিসকিন ও সম্বলহীন পথিকদের বিনয় সূচক জবাব দেয়া (৬) খরচের বেলায় মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা (৭) দারিদ্রের ভয়ে সন্তান হত্যা না করা (৮) জ্বেনার নিকটবর্তী না হওয়া (৯) ন্যায় সঙ্গত কারণ ছাড়া কোনো মানুষ হত্যা না করা (১০) ইয়াতীমের সম্পত্তি আত্মসাৎ না করা (১১) ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা (১২) সঠিক পন্থায় ওজন করা (১৩) যে বিষয়ে মানুষের জ্ঞান নেই, তার পেছনে না ছুটা (১৪) জমিনে অহংকারীভাবে না চলা।
বস্তুতঃ আদর্শ রাষ্ট্র নায়কের মূল উৎস ছিলো আল কুরআন। তা থেকে সংগৃহীত উপরোক্ত ৪ এবং ১৪ দফা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই তিনি রাষ্ট্র শাসনে সফলতা অর্জন করেছিলেন।
* কল্প কথার গল্পে নয় বাস্তব প্রমাণঃ
মুহাম্মদ (সাঃ) আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক তা শুধু কল্প কথার গল্পে নয়, বাস্তবেও তাই। তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হবার পর তাঁর জীবন থেকে কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো –
(১) ভাঙ্গা নয়, গড়ার সুর – সমাজ ও রাষ্ট্রে এখনকার শাসকরা জনগণের মতভেদকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জনগণের মধ্যে হিংসা, বিভেদ ও অনৈক্য প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বকে জাহান্নাম করে তুলছে। অপরদিকে আমরা দেখতে পাই, আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক মদীনা রাষ্ট্র গঠন করেই জনগণের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করলেন। যা ছিলো সুশাসনের জন্য অতীব জরুরী। মদীনার সমাজ ছিল বহুদা বিভক্ত। আওস ও খাজরাজ গোত্রের লোকেরা বংশ পরস্পরায় বিভেদের বীজ বহন করেছিলো। আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক মুহাম্মদ (সা.) তাদেরসহ পুরো মদীনার জনগণকে পরস্পরের শত্রু থেকে কল্যাণকামী বন্ধুতে পরিণত করে দিলেন।
(২) বেকারের হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করা – জনগণের কর্মসংস্থানে যাকাত ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা গঠন করে আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেন। তার প্রেরণায় মদীনার মানুষ কৃষি ও ব্যবসায় প্রচুর উন্নতি সাধন করে। তিনি হীন ভিক্ষা বৃত্তি নিষিদ্ধ করেন। ঘোষণা করেন “নিশ্চয় নিচের হাত থেকে উপরের হাত শ্রেষ্ঠ।” অর্থাৎ গ্রহীতা থেকে দাতা উত্তম। এক ব্যক্তিকে তার শেষ সম্বল একখানা কম্বল বিক্রি করিয়ে তার হাতে কুঠার তুলে দিয়ে কর্ম যুদ্ধে অবতীর্ণ করান। এভাবে জনগণক তিনি কর্মসংস্থানে উদ্বুদ্ধ করে অনুসরণীয় আদর্শ সৃষ্টি করেছেন।
(৩) শিক্ষা বিস্তারে আদর্শ – পবিত্র কুরআনের প্রথম ওহী “ইকরা”। তাই আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক তাঁর জনগণকে শিক্ষিত করতে সর্বদা তৎপর ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন সার্বক্ষণিক শিক্ষক। তিনি মসজিদে নববীকে একটি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করেছিলেন। যুদ্ধবন্দীদের শিক্ষা দানের বিনিময়ে মুক্ত করে দেবার নজির শুধু তিনিই স্থাপন করেছিলেন। বদরের যুদ্ধে বন্দী শিক্ষিত মুশরেকদের অশিক্ষিত মুসলিমকে শিক্ষা দিয়ে মুক্ত হতে তিনি সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
(৪) যুদ্ধ নয়, সন্ধি চাই – মানুষ একটু ক্ষমতাবান হলেই আগ্রাসী হয়ে ওঠে। বর্তমান বিশ্বের ক্ষমতাবানরা এর বাস্তব নজির। অথচ আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক বিশাল ক্ষমতাবান হওয়া সত্ত্বেও সর্বদা যুদ্ধ এড়িয়ে তিনি সন্ধি স্থাপনে আগ্রহী ছিলেন। জীবনে তিনি বহু সন্ধি ও চুক্তি স্থাপন করেছিলেন। এর মধ্যে হুদাইবিয়ার সন্ধি ও ঐতিহাসিক মদীনা সনদ শান্তি স্থাপনে তাকে আদর্শ রাষ্ট্রনায়কে পরিণত করেছে।
(৫) যুদ্ধ ক্ষেত্রে আদর্শ – রাসূল (সা.) কখনো যুদ্ধ চাননি। কিন্তু, যুদ্ধবাজ শয়তানরা বারবার তাঁর উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে ছিলো। তিনি আত্মরক্ষার্থে যুদ্ধ করেছেন। তাই তাঁর জীবনে বদর, ওহুদ, খন্দক, হুনায়েন প্রভৃতি যুদ্ধ এসেছে। তিনি ছিলেন সর্বক্ষেত্রে আদর্শ। তাই যেমন মসজিদে ইমামতি করেছেন, তেমনি যুদ্ধে সেনাপতিত্ব করেছেন। যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রথমে হামলা না করা, নারী-শিশু-অক্ষমদের হত্যা না করা, গবাদী পশু, ফলবতী গাছ-পালা না কাটা এবং যুদ্ধ বন্দীদের সাথে সু-আচরণে একজন রাষ্ট্র প্রধান হিসাবে তিনি উদাহরণ।
(৬) অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সহনশীলতা – সংখ্যালঘুদের প্রতি আদর্শ রাষ্ট্রনায়কের আচরণ অনুসরণীয়। ঐতিহাসিক মদীনা সনদের মাধ্যমে তিনি তাদেরকে যে অধিকার দিয়েছিলেন, তা আজকের দিনে রূপ কথার গল্প। এক ইহুদী মসজিদে নববীতে পেশাব করা শুরু করলো। সাহাবারা তাকে মারতে উদ্যত হলে, বিশ্বনবী বাঁধা দিলেন। কাজ সেরে ফেলার পর নবী (সা.) তাকে বললেন, “তোমার দ্বীনের পবিত্র স্থানে কেউ এমন করলে কি করবে?” লোকটি লজ্জিত হলো। রাসূল (সাঃ) তাকে ক্ষমা করলেন। তাই সে আদর্শ রাষ্ট্র নায়কের আচরণে মুগ্ধ হয়ে ইসলামে দাখিল হলো। তিনি-ই সাহাবীদের আদেশ করেন, “তোমরা মুশরেকদের প্রভূকে গালি দিওনা। তাহলে তারা না বুঝে আল্লাহকে গালি দেবে।”
(৭) দানের ক্ষেত্রে আদর্শ – বিশ্বের শাসকরা যেখানে জনগণের সম্পদ কুক্ষিগত করে সম্পদের পাহাড় গড়ছে, সমুদ্রের বিশালতার হৃদয় দিয়ে আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক সেখানে সব কিছু বিলিয়ে দিয়েছেন। হুনায়েনের যুদ্ধের পর তিনি যা দান করেছিলেন, ইতিহাসে তা বিরল। জুবায়ের ইবনে মুত’য়েম (রা.) থেকে বর্ণিত, হুনায়েন থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় কিছু গ্রাম্য লোক রাসূলকে (সা.) জড়িয়ে ধরলো এবং সাহায্যের আবদার করলো। এমনকি তারা তাঁকে একটি বাবলা গাছের নিচে নিয়ে তাঁর চাদরটি খুলে নিলো। নবী (সাঃ) সেখানে দাড়িয়ে বললেন, “আমার চাদর খানা ফিরিয়ে দাও। যদি আমার কাছে এই কাটা বৃক্ষগুলোর সমান সংখ্যক বকরী বা উট থাকতো তাহলে সবই তোমাদের মধ্যে বিলিয়ে দিতাম। কেননা, আমি কৃপন স্বভাব, মিথ্যাচারী বা ভীরু কাপুরুষ নই।” (বুখারী)
(৮) পরামর্শ গ্রহণে আদর্শ – আদর্শ রাষ্ট্র নায়ক মুহাম্মদ (সা.) সর্ব বিষয়ে একক সিদ্ধান্ত প্রদানের অধিকারী ছিলেন। তথাপি তিনি পরমত সহিষ্ণু ছিলেন। বিভিন্ন পর্যায়ে, তিনি সাথীদের পরামর্শ গ্রহণ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। যেমন- হুদাইবিয়ার সন্ধির পর সাহাবীদের আবেগ প্রশমিত করতে তিনি উম্মে সালমার (রা.) পরামর্শে মাথা মু-ন করেন। খন্দক যুদ্ধে সালমান ফারসীর (রাঃ) পরামর্শে পরিখা খনন করেন। বদর যুদ্ধের ময়দানেও তিনি সাহাবী হুবাব ইবনে মুনযের (রা.) এর পরামর্শ পছন্দ করেন।
(৯) বিজয়ীর মহানুভবতা – আদর্শ রাষ্ট্র নায়কের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে সত্যের দুশমনরা জনগণের মনে জুজুর ভয় সৃষ্টি করতে পেরেছিলো। মক্কা বিজয়ের দিন মিথ্যা ভয়ে লোকজন পালাচ্ছিলো। মহানুভব আদর্শ রাষ্ট্র নায়ক দেখলেন, এক বৃদ্ধা অতিকষ্টে তার লটবহর নিয়ে চলছে। তিনি বৃদ্ধার লটবহর নিজে বহন করে গন্তব্যে পৌঁছে দিলেন। বৃদ্ধা জানালো সে মুহাম্মদের ভয়ে মক্কা ছেড়ে পালাচ্ছে। পরে বললো! কে বাবা তুমি এত ভাল লোক? রাসূল (সা.) বললেন, যার ভয়ে তুমি পালাচ্ছ, আমি সেই আব্দুল্লার পুত্র মুহাম্মদ। বৃদ্ধার জুজুর ভয় কেটে গেলো। সে আদর্শ রাষ্ট্র নায়কের মহানুভবতায় ইসলামে দাখিল হলো।
(১০) রাষ্ট্রনায়কের ক্ষমা – কুরায়শরা আদর্শ রাষ্ট্র নায়ককে এতো অত্যাচার করলো। এমন কি নিজের জন্ম মাটি থেকে উৎখাত করলো। অথচ মক্কা বিজয়ের দিন তাদের উপর কোনো প্রতিশোধ নিলেন না। ক্ষমা করে দিলেন। বললেন, “আজ তোমাদের প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। তোমরা সবাই মুক্ত”। বিশ্ব ইতিহাসে যুদ্ধ জয়ী কোনো আদর্শ রাষ্ট্র নায়কের এমন উদাহরণ শুধু মুহাম্মদ (সঃ)-ই সৃষ্টি করেছেন।
*সচিবালয়
রাষ্ট্র গঠনের ইতিহাসে মহানবী (সা)-এর প্রতিষ্ঠিত মদীনার ইসলামী জনকল্যাণমূলক সর্বোত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। প্রশাসনিক কার্যাবলী সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্যে ছিল একটি সুসংগঠিত সচিবালয়। সচিবালয়ের বিভিন্ন দফতর ও বিভাগসমূহের নাম নিম্নে দেওয়া হলোঃ
@ রাষ্ট্র প্রাধানের ব্যক্তিগত বিভাগ-
(১) হযরত হানযাল ইবন আল রবী (রা), সোণ (সা) এর একাও সচিব (২) হযরত শুরাহবিল ইবন হাসান (রা), সচিব (৩)হযরত আনাস ইবন মালেক ।
@ সীল মোহর বিভাগ-
(১) হযরত মুকার ইবন আবি ফাতিমা (রা) রসূলুল্লাহ (সা:) এর সীলমোহর করার আংটিটি তাঁর নিকট সংরক্ষিত থাকত ।
@ অহী লিখন বিভাগ-
(১) হযরত যায়েদ ইবন সাবিত (রা) (২) হযরত আবু বকর সিদিক (রা) (৩) হযরত ওমর ফারুক (রা) (৪) হযরত ওসমান (রা) (৫) হযরত আলী (রা.) (৬) হযরত উবাই ইবন কাব (রা) (৭) হযরত আবদুল্লাহ ইবন সারাহ (রা) (৮) হযরত যোবায়ের ইবন আল আওয়াম (রা) (৯) হযরত খালেদ ইবন সাঈদ (রা) (১০) হয়রত আবদুল্লাহ ইবন রাওয়া (রা) (১১) হযরত খালেদ ইবন ওলীদ (রা) (১২) হযরত মুগীরা ইবন শোবা (রা) (১৩) হযরত মুআ’বিয়া ইবন আবু সুফিয়ান (রা)। অহী লিপিবদ্ধ করার কাজে যারা নিয়োজিত ছিলেন তাদের সংখ্যা প্ৰায় চল্লিশ জন পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে।
@ পত্ৰ লিখন ও অনুবাদ বিভাগ-
(১) হযরত যায়েদ ইবন সাবিত আনসারী (রা) (২) আবদুল্লাহ ইবন আকরাম (রা) শেষের দিকে মুআবিয়াও (রা) এ কাজে নিয়োজিত ছিলেন ।
@ অভ্যর্থনা বিভাগ-
(১) হযরত আনাস ইবন মালেক (রা) (২) হযরত বারাহ (রা) ।
নবুওতের প্রথম হতেই হযরত বেলাল (রা) মেহমানদারীর কাজে নিয়োজিত ছিলেন ।
@ দাওয়াত ও শিক্ষা বিভাগ-
এ বিভাগটি সম্পূর্ণরূপে রসূল (সা)-এর নিয়ন্ত্রণে ছিল। সাহাবীগণ এ দায়িত্ব পালন করতেন। কুরআনে হাফিজ ও কারাদিগকে অগ্রাধিকার দেওয়া হতো।
@ জাতি ও গোত্ৰসমূহের মধ্যে যোগাযোগ বিভাগ-
(১) মুগীর ইবন শোবা (রা) (২) হাসান ইবন নুসীরা (রা)।
@প্রতিরক্ষা বিভাগ-
মদীনা রাষ্ট্রে কোন বেতনভোগী নিয়মিত সেনাবাহিনী ছিল না; প্রয়োজনে প্রত্যেক সক্ষম মুসলমানই মুজাহিদ হিসেবে যুদ্ধের মাঠে হাজির হতেন। রসূলুল্লাহ (সা) ছিলেন প্রতিরক্ষা বিভাগের সর্বাধিনায়ক। প্রয়োজনের সময় তিনি বিভিন্ন সাহাবীগণকে সেনাপতি নিযুক্ত করতেন। বিভিন্ন সময় মনোনিত কয়েকজন সেনাপতির নাম নিম্নরূপঃ- (১) হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) (২) হযরত ওমর ফারুক (রা) (৩) হযরত আলী মুর্তজা (রা) (৪) হযরত যোবায়ের ইবন আল আওয়াম (রা) (৫) হযরত আবু ওবায়দা ইবন যাররাহ (রা) (৬) হযরত উব|দ ইবন সমেত (রা) (৭) হযরত হামজা ইবন মুত্তালিব (রা) (৮) হযরত মুহাম্মদ ইবন মাসলাম (রা) (৯) হযরত খালিদ ইবন ওয়ালীদ (রা) (১০) হযরত আমার ইবনুল আসি (রা) (১১) হযরত ওসামা ইবন যায়েদ (রা)।
মদীনা রাষ্ট্রের নাগরিকগণ তলোয়ার চালনা, তীর চালনা, বল্লম চালনা ও অশ্ব চালনা শিখতেন। যুদ্ধের বিভিন্ন কলা কৌশলও তাদের শিখানো হতো।
@ নিরাপত্তা বিভাগ-
মদীনা রাষ্ট্রে নিয়মিত কোন পুলিশ বাহিনী ছিল না। স্বেচ্ছায় কিছু সংখ্যক সাহাবী এ বিভাগে কর্মরত ছিলেন। এদের মধ্যে যারা আর্থিক দিক থেকে নিঃস্ব ছিলেন, বায়তুলমাল হতে তাদের ব্যয়ভার বহন করা হত। এ বিভাগের প্রধান ছিলেন। হযরত কায়েস ইবন সায়াদ (রা)।
@ জল্লাদ বিভাগ-
প্রাণদন্ডে দন্ডিত অপরাধীদের শিরচ্ছেদ করার কাজে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নির্দেশে যোগদান করলেন। হযরত যোবায়ের (রা), হযরত আলী (রা), হযরত মেকদাদ ইবন আসওয়াদ (রা), মুহাম্মদ ইবন মুসলিম (রা), আসেম ইবন সাবিদ (রা) এবং দাহহাক ইবন সুফিয়ান কেলবী (রা)।
@ বিচার বিভাগ-
এই বিভাগরে প্রধান ছিলেন। রসূলুল্লাহ (সা) নিজে। প্রাদেশিক কিংবা মদীনায় তিনি নিজেই বিচারপতিদের নিয়োগ করতেন। হযরত আবু বকর, হযরত ওমর, হযরত ওসমান, হযরত আলী, হযরত আবদুর রহমান ইবন আওফ, হযরত মুয়াজি ইবন জাবাল, হযরত আবু ওবায়দা ইবন জাররাহ, হযরত উবাই ইবন কাব্য রসুল (সা) কর্তৃক বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন।
@ হিসেব সংরক্ষণ ও অর্থ বিভাগ (বায়তুল মাল)-
রসূল (সা) নিজেই এ বিভাগের কাজ তদারক করতেন। মুয়ানকী ইবন আবি ফাতিমাও এ বিভাগের সংগে সংশ্লিষ্ট ছিলেন ।
@ যাকাত ও সাদকাহ বিভাগ-
যাকাত ও সাদাকাহ বাবদ যে অর্থ সংগৃহীত হতো তার হিসেব কেন্দ্রীয় ভাবে সংরক্ষণ করতেন। হযরত যোবায়ের ইবন আল আওয়াম ও হযরত যুহাহির ইবন আল সালাত । অঞ্চলের জন্য স্বতন্ত্র আদায়কারী হিসেবে ছিলেনঃ (১) হযরত ওমর- মদীনা (২) আৰু উবায়দা ইন জাররাহ-নাজরান (৩) আমর ইবনুল আস-বনু ফাজারা (৪) আদীি ইবন হাতেম। তাই-বনু তয় ও বনু আসাদ (৫) আবদুল্লাহ ইবন লাইতাই-বনু জাবিয়ান (৬) উৰ্ব্ববাত ইবন বিশার-বনু সুলাইম ও বনু মজায়না। (৭) দহহাক ইবন সুফিয়ান-বনু কিলাব (৮) আবু জাহম ইবন হুজায়ফা-বনু লাইস (৯) বোরায়দা ইবন হােসাইন-বনু গেফার ও বনু আসলাম, (১০) বসুর ইবন সুফিয়ান-বনু কাব। ইহা ছাড়া আরও কতিপয় আদায়কারী ছিলেন। প্রয়োজনে আদায়কারী:দিগকে পারিশ্রমিক দেওয়া হতো ।
@ জনস্বাস্থ্য বিভাগ-
নাগরিকদের চিকিৎসা সুবিধার জন্য এ সময়ের প্রসিদ্ধ চিকি ৎসক হারিস ইবন সালাহ ও আবি রাদার পুত্রকে এ বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারা বায়তুল মাল হতে ভাতা পেতেন। লোকেরা বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধা পেতেন।
@ শিক্ষা বিভাগ-
শিক্ষাবিভাগ ছিল রসূলের (সা) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সাফা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত আকরাম ইবন আবুল আকরাম (রা)-এর বাড়ীতে । মুসলিম উম্মার প্রথম শিক্ষা দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয় মদীনায় শিক্ষা ও স্বাক্ষর জ্ঞানদানের জন্য হযরত আবদুল্লাহ বিন সাঈদ ইবনুল আস (রা:) কে নিয়োগ করা হয়েছিল ।বিশেষ করে হযরত আয়েশা (রা) শিক্ষা বিভাগের কর্মকান্ডে বিশিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে গেছেন। তাদের গৃহগুলো ছিল নারী শিক্ষার কেন্দ্র।
@ পরিসংখ্যান বিভাগ-
রসূল (সা) তাঁর জীবদ্দশায় দু’বার আদমশুমারী করেছিলেন এবং রেজিশটার বইতে  রাষ্ট্রের সকল নাগরিকদের নামের তালিকা প্ৰণয়ন করেন।
@ কৃষি ও বন বিভাগ-
বুখারী শরীফে বর্ণিত হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা (রা) বৰ্ণন। পরেন। রসূল (সা:) এরশাদ করেনঃ যার নিকট চাষাবাদেরযোগ্য জমি থাকবে তার অবশ্যয়
চাষাবাদ করা উচিৎ। অন্যথায় তা অন্য ব্যক্তিকে চাষাবাদের জন্য দিয়ে দেওয়া উচিত।
কুতায়ার ইবন সাঈদ (রা) আনাস (রা) হতে বর্ণিত, নবী (সা) বলেছেন, যে কোন মুসলমান ফলেবান গাছ রোপন করে কিংবা কোন ফসল চাষাবাদ করে আর তা থেকে পাখি কিংবা মানুষ বা চতুষ্পদ জন্তু খায়। তবে তা তার পক্ষে সাদকা বলে গণ্য।
@নগর প্রশাসন বিভাগ-
নগর প্রশাসন বিভাগের দায়িত্ব ছিল শহরে নগরে যাতে করে কোন প্রকার অবৈধ প্ৰবঞ্চনামূলক ক্রয় বিক্রয় না হয় তা নিশ্চিত করা। হযরত ওমর (রা) এ বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
@ স্থানীয় সরকার বিভাগ-
রসূল (সা) প্রত্যেক প্রদেশে একজন করে ওয়ালী বা প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। রসূল (সা)-এর সময় মদীনা রাষ্ট্রে ছিল ৮টি ওয়ালী শাসিত প্ৰদেশ । (১) মদীনা-রসূল (সা) স্বয়ং (২) মক্কা-হযরত ইত্তাব ইবন উসাইদ (রা) (৩) নাজরান-(ক) হযরত আমর ইবন হাজাম (রা) (খ) হযরত আলী (রা) (গ) হযরত আবু সুফিয়ান (রা) (৪) ইয়েমেন-হযরত বায়ান ইবন সামান (রা) (৫) হাজরা মাউত-হযরত যিয়াদ ইবন লবীদুল (রা) (৬) আম্মান-হযরত আমর ইবনুল আস। (রা) (৭) বাহরাইন-হযরত আলী ইবন হাযরাম (রাঃ) (৮) তাইমা-হযরত ইয়াজিদ ইবন আবু সুফিয়ান (রা) (৯) জুন্দে আলজানাদ-হযরত মুয়াজি ইবন জাবাল (রা)।
প্রাদেশিক প্রশাসন ছাড়াও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চল ও বড় বড় গোত্রের উপর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার প্রধান ছিলেন ‘আমিল’ মদীনা রাষ্ট্রের অধীনে এরূপ ২২টি আমিল শাসিত অঞ্চল ও গোত্র ছিল । রসূল (সা) স্বয়ং আমিলদেরকে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ে তালিম দিয়ে বিভিন্ন অঞ্চল ও গোত্রে প্রেরণ করতেন।
পরিশেষে বলা যায়, চৌদ্দশ বছর পূর্বে আদর্শ রাষ্ট্র নায়ক হিসেবে মুহাম্মদ (সা.) বিশ্বের তাবৎ রাষ্ট্র শাসকদের জন্য যে আদর্শ স্থাপন করেছিলেন আজকের বিশ্ব তীব্রভাবে তার অভাব অনুভব করছে। আজ পৃথিবীর দেশে দেশে ভ- শাসকদের শাসন শোষণে পৃথিবীর মজলুম মানুষ একজন আদর্শ রাষ্ট্র নায়কের জন্য আর্তনাদ করছে। শত আর্তনাদেও আর্দশ রাষ্ট্রনায়ক মুহাম্মদ (সা.) আসবেন না বটে। কিন্তু, তাঁকে অনুসরণের মাধ্যমে তার আদর্শ বাস্তবায়ন করে বিশ্বের নির্যাতিত মানুষকে যুলুমের অন্ধকার কু-লী থেকে উদ্ধার করতে কেউ না কেউ এগিয়ে আসবে, এই কামনা আমরা করতেই পারি। যত শীঘ্র এই কামনা বাস্তবায়িত হবে, তত শীঘ্র বিশ্ব মানবতার কল্যাণ সাধিত হবে। দার্শনিক মাইকেল হার্ট যথার্থই বলেছেন, “আমি বিশ্বাস করি অশান্তির বিশ্বে শান্তি আনতে হলে সমগ্র বিশ্বের একক ক্ষমতা আদর্শ রাষ্ট্র নায়ক মুহাম্মদ (সঃ) এর হাতে অপর্ন করলেই তা শুধু সম্ভব।”

বিশ্বনবীর (সা)-এর কতিপয় বিখ্যাত জীবনী লেখক

$
0
0

বিশ্বনবীর (সা)-এর কতিপয় বিখ্যাত জীবনী লেখক

১। আবান ইবন ওসমান (রা) ইবন আফফানঃ
তিনি হিজরি ২০ সনে জন্ম গ্রহণ করেন। তার লিখিত গ্রন্থ ‘মগাজি উর রসুল’ । তিনি তাঁর পিতৃহন্তাগণের বিরুদ্ধে হযরত যুবাইর ও তালহা (রা)-এর পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করেন। হিজরি ১০০ সনে (মতান্তরে ১০৪ বা ১০৫) তাঁর মৃত্যু হয় । হযরত আয়েশা (রা)-এর নিকট শুনে তিনি “মগাজি লিখেন ।
২। উরওয়া ইবনুল যোবাইর (রা) ইবনুল আওয়ামঃ
তিনি ২৩ হিজরিতে জন্ম গ্ৰহণ করেন। তার মাতা আসমার (রা) পিতা। হযরত আবু বকর (রা) । উরওয়া ও আবদুলাহ (রা) সহাদোর ভ্রাতা উভয়ে তাদের খালা হযরত আয়েশা (রা)-এর নিকট লালিত পালিত হন। নিতান্ত শিশু অবস্থায় আবদুল্লাহকে গ্ৰহণ করে হযরত আয়েশা (রা) ইতিহাসে ‘উম্মে আবদুল্লাহ' নামে পরিচিত হন। আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর হেজাজ ও মিসরের খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন । উরওয়া লিখিত ‘মগায়ী” খানিই সুপ্ৰসিদ্ধ। এর লেখককে ইতিহাসের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় । উমাইয়া বংশীয় খলিফা আবদুল মালেক, হযরত রসুলুল্লাহের জীবন চরিত্র বিষয়ক তথ্য জানতে চাইলে উড়য় তার খালার সাহায্যে গ্ৰন্থখানি প্রণয়ন করেন । ৯৪ হিজরিতে (৭১২-১৩ খৃ.) তাঁর মৃত্যু হয়)।
৩। সুরাহবিল ইবন সাদ: 
তিনি একজন মুক্তদাস ছিলেন, দক্ষিণ আরবের অধিবাসী; বন্দর ও ওহুদের জিহাদে লিপ্ত উভয় দলের নামের তালিকা তিনি প্রণয়ন করেন। তিনি আলী (রা)-এর বিশেষ অনুরাগী ব্যক্তি ছিলেন। শতবর্ষকাল জীবিত থেকে হিজরি ১২৩ সনে ইন্তেকাল করেন ।
৪ । ওয়াহাব ইবন মুনাববিহঃ
হিজরি ৩৪ সনে তার জন্ম হয়, ইরানী হলেও তিনি ইয়েমেনে বাস করতেন। তাঁর পিতা সম্ভবত: ইহুদী ছিলেন। ওয়াহাব হিব্রু, খৃষ্টান ও ইসলামী মতবাদের একজন সুপণ্ডিত ছিলেন । তার লেখা কিতাবুল মুবতাদা” নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ বলে গণ্য হয় । আল্লামা আবুল ফজল, “আইন-ই আকবরিতে’ লিখেছেন ওহাব বিন মুন্নাববোহ ইয়েমেনের অধিবাসী ছিলেন । তাদেরকে 'আবনা' বলা হত । কারণ উহারা পারসিক সৈনিকগণের বংশধর । তিনি বর্ণনা ও জনশ্রুতি চালনাকারী বলে কুখ্যাতি অর্জন করে গেছেন। তার নিকট শুনে অনেকে পারস্য, গ্রীক ইমেন এবং মিসরের পুরাকালের ইতিবৃত্ত লিখে ঐতিহাসিক বলে প্রসিদ্ধ হয়েছেন। তিনি দাম্ভিক ও মিথ্যাবাদী বলে পরিচিত। মুসলিম সমালোচকরা পরবর্তীকালে তাকে মিথু্যক ও নির্লজ্জ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর অবশ্য এইরূপ উক্তি সম্ভবপর হয়েছে। ইবন খাল্লিকানের বর্ণনায় তা লিপিবদ্ধ হয়েছে দেখা যায় । তিনি ইয়েমেনের রাজধানী সানায় মুহররম মাসে ১১০ হিজরিতে (৭২৮ খৃ. এপ্রিল বা মে) মাসে মারা যান অন্যেরা বলেন যে, ১১৪/১৬ হিজরিতে মৃত্যুমুখে পতিত হন।
৫ । আসিমা ইবন আমার (মতান্তরে উমর) ইবন মুকতাদা আল আনসারীঃ
রসুলুল্লাহ (সা)-এর যুদ্ধকালীন বিবরণীসমূহ লিখিত ও মৌখিকভাবে বর্ণনা করতেন। তিনি এ বিষয়ে বক্তৃতা দিবার জন্য দামেস্কে গিয়েছিলেন। যুদ্ধ ক্ষেত্রে সৈনিকগণের আচরণ সম্বন্ধে পরিষ্কার ও যথাযথভাবে উল্লেখ করতেন। বাসস্থান মদিনায় ফিরে এসে বক্তৃতা দিলে ইবন ইসহাকসহ বহু গুণী ব্যক্তি তথায় উপস্থিত হতেন । তার বক্তৃতার বিশেষত্ব এই যে, তিনি পবিত্র কুরআনের আয়াত কদাচিৎ এবং হাদিসের অতি অল্প উল্লেখ করতেন। ভাষণে তিনি নিজ অভিমত দান করতেন । ১২০ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।
৬। মুহাম্মদ ইবন মুসলিম ইবন শিহাব আজ-জুহরীঃ
মক্কার বিখ্যাত কোরেশ বংশের অন্যতম শাখা জুহরী কুলোদ্ভব। আজ জুহরী একজন সর্বজন-মান্য ব্যক্তি এবং সুপ্ৰসিদ্ধ হাদীসবেত্তা। তিনি হিজরি ৫১ সনে জন্ম গ্ৰহণ করেন। উমাইয়া খলিফা আবদুল মালেক, হিসাম ও দ্বিতীয় ইয়াজিদের দরবারে যাতায়াত করতেন, তাকে বিশেষ সম্মান দেওয়া হতো । তিনি নিজ বংশের একখানি ইতিহাস রচনা করেন। এবং একখানি মাগায়ী গ্রন্থ লিখে রেখে গেছেন। তিনি যখন বক্তৃতা দিতেন, উপস্থিত জনমন্ডলীর অনেকেই হাদিসগুলো লিখে নিতেন । তিনি মদিনায় অনেকদিন বাস করেছিলেন। তখন ইবন ইসহাকের সাথে তার সাক্ষাৎকার ঘটে । ইবন ইসহাক তার গ্রন্থে আজ-জুহরীর নাম উল্লেখ করেছেন। আজ-জুহরীর বর্ণনা ও হাদিসের ব্যাখ্যা সকলের গ্রহণীয়, তিনি একজন প্রভাবশালী রাবী ছিলেন। তিনি ১২৪ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন । ৭। আবদুল্লাহ ইবন আবু বকর মুহাম্মদ ইবন আমর ইবন হাজমঃ
তিনি মুহাম্মদ ইবন ইসহাকের প্রায় প্রধান অবলম্বন । খলিফা উমর ইবন আবদুল আজিজ আবদুল্লাহর পিতা আবু বকরকে রসূলুল্লাহ (সা)-এর হাদীসগুলো লিখতে বলেছিলেন, বিশেষ করে আমরা বিন্তে আবদুর রহমানের নিকট যেগুলো তিনি শুনেছেন । কারণ আয়েশার (রা) ভ্রাতুষ্পপুত্রী, আমরা বিন্তে আবদুর রহমান এবং আবু বকর ছিলেন বিবি আমরার ভ্রাতুষ্পত্র। আবু বকরের লিখিত পুস্তক আব্দুল্লাহর সময়ে নষ্ট হয়ে যায়। তদীয় ভ্রাতুষ্পপুত্র আবদুল মালেক রচিত ‘মগায়ী’তে এর উল্লেখ আছে। তাবারী বলেছেন যে, আবদুল্লাহ তাঁর স্ত্রী ফাতেমাকে বলেছিলেন যে, ইবন ইসহাককে বলে যে, আমি আমরার প্রদত্ত প্রামান্য বিষয় জানি, তিনি হিজরী ১৩৫ সনে (মতান্তরে ১৩০ বা ১৩৫ সনে) ইন্তিকাল করেন।
৮। আবুল আসওয়াদ মুহাম্মদ ইবস আবদুর রহমান ইবন নওফলঃ
তিনি তার লিখিত ‘মগাষী খানি উরওয়া ইবনুন্য যোবাইরের (রা:) হাদীসগুলোর উপর নির্ভর করেই লিখেছেন । উপরোল্লিখিত লেখকগণের লিখিত পুস্তকগুলি বর্তমান নাই । তবে পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকগণ তাদের পুস্তকের যথার্থতা প্রমাণের নিমিত্ত ওদের উক্তি পুনঃ পুনঃ উল্লেখ করে অর্থাৎ বরাৎ দিয়ে নিজেদের গ্রন্থসমূহ লিখেছেন, তারা হচ্ছেন যথাক্ৰমেঃ
(ক) মুসা ইবন উকবাঃ ইনি যে, মগাষী খানি প্রণয়ন করেন, তার কিছু অংশ পাওয়া গেছে, এবং অনুবাদ হয়েছে বলে প্রকাশ। ইনি হিজরী ৫৫ সনে জন্মগ্রহণ করেন। আজ-জুহরী ও ইবন আব্বাসের উক্তি অবলম্বনে গ্ৰন্থখানি লিখিত, ফলে তা অধিকতর নির্ভরযোগ্য এবং ইমাম মালিক বিন আনাস, আহমদ বিন হামবল এবং আশা-সাফী এই মগায়ীখানির সমর্থক ছিলেন ।
এ৩ি২|সিক আল-ওয়াকিদী, আল-বালাজুরী, ইবন সাদা ও ইবনে সাইয়াদুন শমের গ্রন্থগুলো, মুসা বিন উকবার উল্লেখ করেই লিখিত হয়েছে। এই মগাষী খানিকে ভিত্তি করেই অধিকাংশ ইতিহাস রচিত। আত তাবারীকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করতে হলেও তিনি ইবন ইসহাক ও ইবন উকবার অনুসারী, স্বীকার করতে ৩য় । ১৪১ হিজরী (৭৫৮/৫৯ খৃ) তাঁর মৃত্যু হয়
(খ) মুয়ামামার ইবন রশীদঃ তার লিখিত কোন পুস্তকের নামের উল্লেখ না থাকলেও তিনি অন্যান্য গ্রন্থের লেখকদের নিকট ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত দেখা যায় । তিনি হিজরী ১৫০ সনে মারা যান।
(গ) মুহাম্মদ ইবন ইয়াসারঃ তিনি হিজরী ৮৫ সনে জন্ম গ্রহণ করেন। ইসলামের ইতিহাসের পূর্ববতী লেখকগণের গ্রন্থগুলো যথাযথভাবে না পাওয়া গেলেও কেবল পরবর্তী লেখকগণের মাধ্যমে আমরা সেগুলোর সন্ধান পেয়ে থাকি। কিন্তু মুহাম্মদ বিন ইসহাকের লিখিত গ্ৰন্থখানির সম্পূর্ণ অংশই বিদ্যমান, দেখা যায় তিনি তার “সীরাতে’র যে যে স্থান ব্যাখ্যা করেছিলেন, তালিকায় ১৫ জনের নাম পাওয়া গেছে এবং সেই স্থানের উল্লেখও দেওয়া হয়েছে। তার লিখিত গ্ৰন্থখানিতে হযরত রসূলুল্লাহ (সা)-এর জীবনী যেরূপ বিশদভাবে লেখা হয়েছে অন্য কোন ইতিহাস সেরূপ পূর্ণাঙ্গ তথ্য পরিবেশন করতে সক্ষম হয়নি। গ্ৰন্থখানির প্রথমভাগে মানব জাতির সৃষ্টি কাল হতে হযরত ঈসার আবির্ভাব পর্যন্ত, দ্বিতীয়ভাগে ওহাব বিন মুনবাবিহের ‘কিসাসুল আম্বিয়া’ বা কিতাব আলমূবতাদা বা মাবদা এবং ‘আর ইসরাইলীয়াত' হতে ইহুদী ও খৃষ্টানদের বিবরণী, প্রাচীন আরবদের ইতিবৃত্ত ও ধর্ম সংক্রান্ত তথ্য, মরুভূমির আরবদের উপাখ্যানিক জ্ঞান, ইসলাম-পূর্ব যুগের ধর্ম বিষয়ক বিবরণ, রসূলুল্লাহ (সা)-এর পূর্ব পুরুষদের পরিচয় এবং মক্কার প্রাচীন ধর্ম ইত্যাদি, তৃতীয় অংশে তাঁর হিজরতকাল হতে সমুদয় অভিযান, আনসার ও মুহাজিরীনদিগের সম্পর্কের পরিপূর্ণ আভাস প্রভৃতি, আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস ও আব্দুল্লাহ ইবন আবু বকরের উক্তিসমূহের প্রদত্ত বিষয়গুলো লিপিবদ্ধ করেছেন। এছাড়া বহু বর্ণনাকারীর নিকট হতে জেনে গ্ৰন্থখানি সর্বাঙ্গীন সুন্দর করে গেছেন । আইন-ই-আকবরীতে আবুল ফজল লিখেছেন, মুহাম্মদ বিন ইসহাক, “আল-মাগায়ী আস-সিয়ারে” নামক গ্রন্থে সুবিখ্যাত লেখক, তিনি মদীনার অধিবাসী ছিলেন এবং উচ্চশ্রেণীর ইতিহাসবেত্তা, ইমাম বুখারী ও আশ-শাফী তাকে প্রধানতঃ মুসলিম বিজয় লাভ সম্পর্কে প্রথম বিধি সঙ্গত সাক্ষী বলেছেন; তিনি বাগদাদ হিজরী ১৫.১ (খৃ. ৭৬৮) অব্দে মৃত্যুমুখে পতিত হন। তাঁর লিখিত গ্রন্থ হতে ইবন হিশাম, রসূলুল্লাহ (সা)-এর জীবনীর উপকরণ সংগ্ৰহ করেন।

(ঘ) যিয়াদ ইবন আবদুল্লাহ আল-বাককাইঃ ইনি মুহাম্মদ বিন ইসহাকের
ছাত্র ছিলেন। ইবন ইসহাকের গ্রন্থের দুইখানি নকল করেন এবং তাকেই অবলম্বন করে বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি কুফায় ১৮৩ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
(ঙ) আবু মুহাম্মদ আবদুল মালিক ইবন হিশাম আল হিময়ারীঃ তিনি যিয়াদ আল-বাককাইকে অনুসরণ করে দুইখানি গ্ৰন্থ রচনা করেন। ইবন ইসহাকের একখানি গ্রন্থের নকল আল-বাককাই মারফত পেয়েছিলেন, তা হতেই তিনি “সীরাতে রসূলুল্লাহ’ গ্ৰন্থখানি সংকলন করেন এবং ব্যক্তিগত কারণে “কিতাবে আত-তিজান লি-মারিফতী মুলুকিল জামান” বা “ফি আখবারে কাহতান” লিখেছেন। তিনি হিজরী ২১৮ সনে মৃত্যুমুখে পতিত হন। তিনি বসরায় জন্ম গ্রহণ করেন এবং মিসর ফুস্তাত্ নামক স্থানে মৃত্যু হয়। তাঁর গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, ইবন ইসহাকের পুস্তকখানি সম্পূর্ণরূপে তার ও আল-বাক কাইর হস্তগত হয় নাই। তিনি হযরত আদম (আ) হতে হযরত ইবরাহীম (আ.) পর্যন্ত বিবরণী সমূহ লিপিবদ্ধ করেন নাই, তবে ক্রটি স্বীকার ও যোগ করে নেওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন । এতে হযরত ইসমাঈল (আ) হতে আরম্ভ করে হযরত রসূলুল্লাহ (সা)-এর পূর্বপুরুষগণের ইতিহাসের বর্ণনা আছে। “সীরাতে রসূলুল্লাহ" গ্ৰন্থখানি বর্তমানে একটি নির্ভরযোগ্য জীবন চরিত। ইহা মুহাম্মদ ইবন ইসহাকের মূল গ্রন্থের অভাব দূর করেছে বলে উল্লেখিত । ৮২৮/২৯ খৃ. তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন।
(চ) মুহাম্মদ ইবন উর আল-ওয়াকিদীঃ তিনি তার “আল-মগাজী” গ্রন্থখানি প্রণয়ন করেন। তাঁর রচিত জীবন চরিত পুস্তক হতে হযরত রসূলুল্লাহ (সা)-এর বিবিধ বিবরণীর সন্ধান পাওয়া যায়। গ্ৰন্থখানির বিষয়ে আইন-ই-আকবরী হতে জানা যায় যে, তিনি আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবন উমর ওয়াকিদ আল-ওয়াকিদী; তার জন্মস্থান মক্কা নগরীতে । তিনি বিখ্যাত পুস্তক “বিজয় লাভ” লিখে সুপ্ৰসিদ্ধ হয়েছেন। হিজরী ১৩০ সনে সেপ্টেম্বর ৭৪৭ খৃ জন্মগ্রহণ করেন। হিজরী ২০৬ সন ১১ যিলহজ্জ সোমবার তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। (২৭ এপ্রিল, ৮২১ খৃ) মতান্তরে হিজরী ২০৭ সনে ।
(ছ) আবুল ওয়ালিদ মুহাম্মদ ইবন আবদুল্লাহ আল-আজরাকঃ তিনি “আখবারে মক্কা” নামীয় একখানি গ্রন্থ লিখেছিলেন, গ্ৰন্থখানি বিশেষ মূল্যবান। তিনি মুহাম্মদ ইবন ইসহাকের বর্ণনাকারী ওসমান বিন সাজ বা তার পিতামহের নিকট শ্রবণ করে পুস্তকখানি সম্পাদন করেন । হিজরী ২২০ সনে তাঁর মৃত্যু হয়
(জ) মুহাম্মদ ইবন সা'দঃ তিনি আল-ওয়াকিদীর ছাত্র ছিলেন। হযরত রসূলুল্লাহ (সা)-এর জীবন বৃত্তান্ত বিষয়ে একখানি বিরাট গ্রন্থ লেখেন, তা-ই “কিতাবুত তাবাকাত আল কবীর” নামে সুপ্ৰসিদ্ধ। তার অপর একটি গ্রন্থ “আখবারুন নবী”। পরবর্তীকালে উভয় গ্রন্থ একত্রিভূত হয়ে যায়। তিনি যে সংকলন করেন, তার অধিকাংশ আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) প্রদত্ত বর্ণনা।
তিনি  ইবন আব্বাসের বর্ণনা হতে অনেক ঘটনার বিবরণী লিপিবদ্ধ করেছেন যা  সাধারণের নিকট অজানা ছিলো বলে মনে হয় । তিনি হিজরী ২৩০ সালে (৮৪৪/৪৫ খৃস্টাব্দে) পরলোক গমন করেন।
(ঝ)আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবন মুসলিম ইবন কুতায়বাঃ
তাঁর গ্ৰন্থখানি “কিতাবুল মাআরিফ” নামে পরিচিত । তিনি ২৭০ বা ২৭৬ হিজরীতে
ইন্তেকাল করেন। আইন-ই আকবরীতে দেখা যায় যে, তিনি হিজরী ২১৩ সনে জন্মগ্রহণ  করেন এবং ২৭০ হিজরীতে মারা যান। তার জন্মস্থান দীনাওয়ার নামাক স্থানে। কিন্তু অন্যত্র উল্লেখ আছে যে, তিনি মার্ভের অধিবাসী ছিলেন এবং দুইটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন, “কিতাব আল মাআরিফ ও আদাবুল কাতিব৷” (সচিবগণের নির্দেশিকা) এটাই প্রথম সাধারণ জ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ। পুস্তক খানিতে মুসলিমগণের প্রাথমিক যুগের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত প্ৰদান করা হয়েছে, । পরবর্তীকালে উভয় গ্রন্থ একত্রীভূত হয়ে যায়।
৯ । আবু সাঈদ আবদুল মালিক ইবন কুরাইব আল-আসমাইঃ
তিনি একজন ঐতিহাসিক এবং বিশিষ্ট ভাষাতত্ত্ববিদ ছিলেন । আরবী ভাষায় শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন । তার জন্মস্থান বসরা, কিন্তু খলীফা হারুন রশীদের রাজত্বকালে তিনি বসরা ত্যাগ করে বাগদাদে গিয়ে বসবাস করেন। তিনি ১৬০০০ শ্লোক কণ্ঠস্থ করেছিলেন বলে উল্লেখ আছে। হিজরী ১২২ সনে (খৃ. ৭৪০ অব্দে) জন্মগ্রহণ করেন এবং হিজরী ২১৩ সনে (খৃ. ৮২৮ অব্দে) মৃত্যু বরণ করেন।
১০ । ইবনুল কালীবীঃ
তিনি হিজরী ২০৪ বা ২০৬ সনে প্ৰাণ ত্যাগ করেন। তার বিখ্যাত গ্রন্থ “কিতাবুল আসনাম” । ইবনে ইসহাকের শাগরিদ ইউনুস বিন বুকাইরের প্রতি বিশ্বাসী ছিলেন, এবং তাকে অনুসরণ করেই অধিকাংশ বিষয়ের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায় |
১১ । মুহাম্মদ মুকান্নাঃ
প্রকৃত নাম মুহাম্মদ ইবন ওহমাইজাহ । তিনি তার দেহের ও মুখের লাবণ্য রক্ষা করার নিমিত্ত অবগুণ্ঠন বা ঘোমটা দিয়ে ঢাকা থাকতেন, তজন্য তাকে “মুকান্না” বলা হতো। তার প্রভূত ধন সম্পদ দান খয়রাত ও অপব্যয়ে ব্যয়িত হয়ে যায় । বহু আত্মীয় স্বজন তার নিকট ঋণী ছিলো, তথাপি তাকে দারিদ্রের মধ্যে জীবন যাপন করতে হয়। তিনি উমাইয়া বংশীয়গনের রাজত্বকালের সময় বর্তমান ছিলেন।
১২। আবু আমার (পরে) আবু মুহাম্মদ ইবনুল মুকাফফাঃ
তিনি একজন বিখ্যাত কাতিব(সচিব) নামে পরিচিত। অনেকগুলো পত্রসম্পর্কীয় পুস্তক লিপিবদ্ধ করে প্ৰশংসি৩ হয়েছিলেন । ‘কালীলা ও দিমনা’ নামক গ্ৰন্থখানি আরবী ভাষায় অনুবাদ করেন। 
১৩ । আবুল ফারাজ আল ইসফাহানীঃ
তিনি হিজরী ৩২৭/২৮ সনে জন্ম গ্রহণ করেন। তার বিখ্যাত গ্ৰন্থ “কিতাবুল আগানী” । তিনি হিজরী ৩৮৭ সনে ইন্তিকাল করেন। (খৃ. ৮৯৭-৯৬৭ অব্দ)।
১৪। ইউসুফ বিন ইয়াহইয়া আত-তীদালীঃ
(ইবনুল জাইয়াত নামে পরিচিত)। তিনি হিজরী ৬২৭ সনে মারা যান ।
১৫। আহমদ ইবন ইয়াহইয়া বালাজুরীঃ
তিনি মুসলিম বিন উকবার অনুসরণ করে যে পুস্তকখানি প্রণয়ন করেন, তা-ই সুবিখ্যাত “ফতুহুল বুলদান” । প্রধানতঃ এটাই দেখা যায় যে, যৎকালে আজ-জুহরী ও ইবন ইসহাক এবং মুসা ইবনে উকবা বিদ্যমান ছিলেন, তখনই ইসলামের ইতিহাসের ভিত্তি প্রস্তর দৃঢ় রূপে প্রোথিত হয়। তাদের অনুসরণ করে বহু মনীষী মূল্যবান গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। বালাজুরী তন্মধ্যে একজন এবং অন্যতম বিশ্বস্ত লেখক বলে পরিচিত। তার লেখনীতে বিবিধ তথ্যাবলী সম্যকরূপে পরিবেশিত হয়েছে। তার অপর গ্রন্থ “আস সাবউলআশরাফ” বলে জানা যায়। তিনি হিজরী ২৭৯ সনে ইন্তিকাল করেন।
১৬। আবু জাফর মুহাম্মদ ইবন জরীর “আত-তাবারীঃ
পবিত্র কুরআনের অন্যতম ভাষ্যকার এবং বিখ্যাত ইতিহাস প্রণেতা ও হাদীস শাস্ত্ৰবিদ। তার সুপ্ৰসিদ্ধ ইতিহাস “তারিখুর-রসূল ওয়া মুলুক” (নবীগণের ও শাসকগণের ইতিহাস)। তিনি তাবারিস্তানের অন্তর্গত আমূল অঞ্চলে হিজরী ২২৪ সনে জন্মগ্রহন করেন। (খৃ. ৮৩৮ অব্দ)। তাঁর লিখিত গ্রন্থগুলি “আমুলের সাহিত্য” বলে সুপরিচিত। এতে খৃ. ৯১৫ অব্দ পর্যন্ত বিবরণী দেওয়া আছে। তিনি হিজরী ৩১৯ সান (খৃষ্টাব্দে ৯৩১ অব্দে) বাগদাদে প্ৰাণত্যাগ করেন।
১৭। আসিম কুকীঃ
তার প্রকৃত নাম মুহাম্মদ ইবন আলীঃ আসিম কুফী বলে সর্বজন পরিচিত। তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘ফতুহ আসিমা”। হযরত রসূলুল্লাহ (সা)-এর ওফাতের পর হতে কারবালা প্ৰান্তরে হযরত ইমাম হোসাইন (রা) শহীদ হওয়া পর্যন্ত বিশদ বিবরণ ও তথ্যসমূহ দেওয়া আছে।
১৮। আবু সাঈদ আল-হাসান ইবন আবদুল্লাহ আস-সিরাফীঃ
তিনি একজন বিশিষ্ট গ্রন্থকার বলে গণ্য। তিনি হিজরী ৩৬৮ সনে ইহলোক ত্যাগ করেছেন। তাঁর বিশিষ্ট গ্ৰন্থখানি “আখবারুন নাযিরাইন আল-বাসরিইন” নামে পরিচিত। ১৯। আবুল হাসান আলী ইবন মুহাম্মদ ইবন হাবীব আল-মাওয়ারদীঃ
ইনি হিজরী ৪৫০ সনে প্ৰাণত্যাগ করেন।
২০। আবু ফতেহ মুহাম্মদ ইবন মুহাম্মদ ইবন সাইয়েদুন্নাস আল-ইমারী আল-আন্দালুসীঃ তার প্রসিদ্ধ পুস্তক “উয়ুন আল আশীর ফি ফুনু মিল মাগাজি আশ শামাইল আসসিয়ার” ইতিহাসখানি “কিতাবুত তাহজীব আল-আসমা” বলেও পরিচিত। তিনি হিজরী ৭৩৪ (খৃ. ১৩৩৪ অব্দে) মৃত্যুমুখে পতিত হন।
২১। আবুল হাসান আলী ইবনুল আহীর আল-জাযারীঃ
ইনি দুইখানি পুস্তক প্ৰণয়ন করেন, উক্ত পুস্তকদ্বয়-“আলকামিল ফিত তারিখ” এবং “উসদুল গাব৷” নামে পরিচিত। তিনি হিজরী ৬৩০ (খৃষ্টীয় ১২৩৩ অব্দে) মৃত্যুবরণ করেন)।
২২। ইসমাঈল ইবন উমর ইবন কাসিরাঃ
তিনি “রিওয়াইয়া” নামক সুবিখ্যাত গ্রন্থের জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তিনি হিজরী ৭৭৪ সনে (খৃষ্টীয় ১৩৭২ অব্দে)
২৩। আহমদ ইবন আলী মুহাম্মদ আল-কাস্তলানীঃ
তিনি যে গ্ৰন্থখানি রচনা করেন, তা “আল মাওয়াহিবুল-লাদুননীয়াহ।” এছাড়া হাদিস সংক্রান্ত গ্ৰন্থখানি তিনি ইমাম বুখারীর টীকাকার রূপে লেখেন “ইরশান্দুসসারী ফণী শারীহি সহী আল-বুখারী” নামে প্রসিদ্ধ। তিনি হিজরী ৯৬৫ সনে (১৫৫৭ কৃ.) প্রাণত্যাগ করেন ।
২৪। আবুল ফজল আহমদ ইবন আলী-ইবন হাজার আসকালানীঃ
হিজরী ৭৭৩ সনে আসকালান নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনিও ইমাম বুখারীর টীকাকার ছিলেন।” তৎলিখিত পুস্তকখানি “ফাতহুল বারী ফিশারীহি সহীহ আল বুখারী” নামে পরিচিত। অপর গ্রন্থ “তাহজীব (সভ্যতা)” । তিনি হিজরী ৮৫২ সনে ১৪৪৯ খৃ. মৃত্যুবরণ করেন।
২৫। আল-মোতাহার আত তাহিরঃ
তিনি আল-আজম্যাবীর অনুসারী ছিলেন এবং আজযাবীর “আখবারে মক্কা” পুস্তক হতে একখানি জীবনী লিখে গেছেন।
২৬। আল জুমাহীহঃ
ইনি যে পুস্তকখানি রচনা করেছেন-- তা মুহাম্মদ ইবন সাদ লিখিত “কিতাবুত-তাবাকাত আল-কুবরা” কে মূল রূপে গ্ৰহণ করে “তাবাকাতুস সুরারা” নামক গ্ৰন্থখানি প্রণয়ন করেন। তিনি ২৩১ হিজরীতে মারা যান।
২৭। আল হাকিম নিশাবুরীঃ
ইনি “মুস্তাদরাক’ নামক একখানি হাদীস গ্রন্থ লিপিবদ্ধ করেন ।
২৮। আস সুহাইলীঃ
তার বিখ্যাত পুস্তকখানি “আর-রাউন্দুল উনুফি’ নামে পরিচিত ।
২৯। ইবনুন নাদীমঃ
একজন সুপ্ৰসিদ্ধ গ্রন্থকার “আল-ফিহরীস্ত” গ্রন্থখানি বিশ্বের আদরণীয় পুস্তক বলে গণ্য, তা কায়রো হতে প্রকাশিত হয়েছিল।
৩০। হাফিজ ইমাদুদ্দীন ইসমাঈল বিন আবদুল্লাহ আদি দিমাশকীঃ
তিনি হিজরী ৭৭৪ সনে (১৩৭২ খৃ. মৃত্যুমুখে পতিত হন। তার লিখিত ইতিহাসখানি “আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া” তার জীবনকাল পর্যন্ত লিপিবদ্ধ করেছেন।
৩১। শাহাবুদ্দীন আবু মাহমুদ আস-সাফায়ী মুকাদদিসীঃ
তার গ্ৰন্থখানি “মাসিরুল গারাম ইল জিয়ারাতিল কুদস। ওয়াশ-শামস” । তিনি হিজরী ৭৬৫ সনে (১৩৬৩ খৃ.) পরলোক গমন করেন।
৩২। আবুল হাসান আলী ইবন হুসাইন ইবন আলী আল-মসউদ্দীঃ
তিনি খৃষ্টীয় নবম শতাব্দীর শেষ ভাগে বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পরিব্রাজকরুপে ভ্ৰমণে বের হয়ে বহু দেশ পর্যটন করেন । ৯১৫ খৃষ্টাব্দে ইসিতাখার অঞ্চল পরিদর্শনকালে পুরত্ব বিষয়ে সবিশেষ আগ্রহী হয়ে পর বৎসর মুলতান, মনসুরা, ক্যাম্বে সিয়ামুর
ও সিংহলে উপস্থিত হন । তথা হতে মাদাগাস্কার, তোমান পরিভ্রমণ করে চীনে উপস্থিত হয়ে কিছুদিন তথায় অবস্থান করেন । পুনরায় যাত্রা আরম্ভ করে ক্যাসপিয়ান সাগরস্থিত দেশ দর্শন করার পর তাব্রিজ এবং প্যালেষ্টাইন অঞ্চলের প্রাচীন স্মৃতিগুলোর এবং খৃষ্টানদের গির্জাসমূহের ধ্বংসাবশেষের বিস্তৃত বিবরণী লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তৎপর ৯৭৩ খৃস্টাব্দে অ্যান্টিক নগরের স্মরণ চিহ্নগুলো পরিদর্শন কর দামেস্কে দুই বৎসরকাল অবস্থান করেন। জীবনের শেষ দশ বছর সিরিয়া ও মিশরে অতিবাহিত করেন । তার জীবনের লক্ষ্য ছিলো, স্বচক্ষে দেশে তথাকার সমস্ত বিষয়ের বিবরণী সংগ্ৰহ করা, ফলে তিনি কেবল ইতিবৃত্তই নয়, বরং তাদের আচার-ব্যবহার ও কার্যকলাপের যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয়গুলোও পরিহার না করে সমুদয় তথ্যের বর্ণনা দিয়ে বিরাট গ্রন্থ রচনা করেন।
আবশ্যকবোধে পারসিক, ইহুদী, হিন্দু ও খৃস্টানদের কাহিনীসমূহ বিবৃত করেছেন। তাঁর সুপ্ৰসিদ্ধ গ্রন্থ “কিতাব আখবারউয যামান” বা “যুগের ইতিহাস” ৩০ খন্ডে লিখিত। পরিশিষ্ট পুস্তকখানি “কিতাবুল আওসাত” নামে পরিচিত। আর একখানি বিশিষ্ট গ্রন্থ “মুরু জুয যাহাব” বা “সোনার খণি” পুস্তকখানি ইতিহাস বৃত্তান্তমূলক । তিনি প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলি ৯৪৭ খৃষ্টাব্দে হতে ৯৫৬ খৃ. পর্যন্ত সময়ের মধ্যে লিখেছিলেন । তৎকালে বাগদাদে খলীফা মুতী’ বিল্লাহ সিংহাসনে আরোহণ ছিলেন। মসউদ্দী তাঁর গ্রন্থে পৃথিবীর সৃষ্টিকাল হতে আরম্ভ করে সম-সাময়িক খলীফাগণের ইতিহাস রচনা করেন। হিজরী ৩৪৬ সনে (৯৫৭ খৃ.) এই সুবিখ্যাত ঐতিহাসিকের জীবনের অবসান ঘটে, তৎকালে তিনি কায়রো নগরীতে অবস্থান করতেন ।
৩৩। ইবন খল্লিকানঃ
একজন প্ৰসিদ্ধ জীবনচরিত লেখক । তার লিখিত গ্ৰন্থখানি “ওফায়াতুল আয়ান” । তিনি পুস্তকটিতে মহান ও বিখ্যাত মনীষীদের জীবন বৃত্তান্ত বর্ণনা করে সুন্দর রূপে সুসজ্জিত করেছেন। তিনি হিজরী ৬০৮ সনে (১২১১ খৃ.) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুস্তকখানি মিশরের মামলুক বংশীয় নৃপতি সুলতান বায়বাসের কর্তৃত্বাধীনে লিখিত হয়েছিল। গ্ৰন্থখানির শেষাংশের তিনি তাঁর মৃত্যুকাল হিজরী ৬৭২ সন (১২৭৩-৭৪ খৃ.) পর্যন্ত ঘটনার উল্লেখ করেছেন।
৩৪। আবদুল্লাহ ইবন আসাদ আল জাফায়ী আল ইমেনীঃ
তার লিখিত গ্ৰন্থখানি “মীরাতে আল জানান, ওয়া ই-বরাতুল ইয়াকজানি।” তিনি হযরত রসূলে করীম (সা)-এর মদীনায় হিজরত কাল হতে আরম্ভ করে তাঁর জীবন কাল পর্যন্ত যাবতীয় বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন । গ্রন্থকারের অপর পুস্তক “রওদাতুর রিয়াহীন ।” তা মুসলিম সুফী সাধকদের জীবন কাহিনীতে সুশোভিত ও সজ্জিত । তিনি হিজরী ৭৬৮ সনে (১৩৬৬ খৃঃ) মৃত্যুমুখে পতিত হন।
৩৫। আহমাদ ইবন সাইয়ার ইবন আইউবঃ ইনি একখানি হাদীস গ্রন্থ, আবুল হাসান আল-মারও জীকে অনুসরণ করে সম্পাদন করেন। এভাবে তিনি হাদীস
বর্ননাকারি হিসেবে সুবিখ্যাত হন । তার বর্ণিত হাদীসমূহ বিশুদ্ধ বলে খ্যাত এবং মূল্যবান। তিনি হিজরী ২৬৮ সনে (৮৮১) অব্দে ইন্তিকাল করেন।

নারী ও পুরুষ( বাউল ভেদে)

$
0
0

নারী ও পুরুষ( বাউল ভেদে)
বাউল লোকসম্প্রদায়ের একটি সাধন-ভজন গোষ্ঠী, যারা গ্রামে-গঞ্জে গান গেয়ে ভিক্ষা করে বেড়ায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এদের দেখা গেলেও সাধারণত কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর, যশোর এবং পাবনা অঞ্চলেই এদের বেশি দেখা যায়। বাউলরা দেহভিত্তিক গুপ্ত সাধনার অনুসারী। এই সাধনায় সহজিয়া ও সুফি সাধনার সম্মিলন ঘটেছে; তবে সুফি ভাবনার প্রভাবই বেশি। বাউলরা মসজিদ বা মন্দিরে যায় না। কোনো ধর্মগ্রন্থে তাদের বিশ্বাস নেই। মূর্তিপূজা, বর্ণবৈষম্য বা জাতিভেদে তারা বিশ্বাসী নয়। তারা মানবতাবাদী। তাদের বিশ্বাস জন্মগতভাবে কেউ বাউল নয়, গুরুর নিকট দীক্ষা নিয়েই বাউল হতে হয়। বাউল সাধনা মূলত নারী-পুরুষের যুগলসাধনা। তবে জ্ঞানমার্গীয় একক যোগসাধনাও আছে।
গবেষক সৈয়দ মোস্তফা কামাল, ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী সহ অনেকে এ অভিমত পোষন করেন; মধ্যযুগের প্রারম্ভে বাংলার শ্যামল জমিনে অদৈত্ববাদের মধ্যদিয়ে ভারতে চৈতন্যবাদ বিকশিত হয় পঞ্চদশ শতাব্দিতে। তখন ভাগবতধর্ম, আদি রামধর্ম ও কৃষ্ণধর্মের মিলনে বৈঞ্চবধর্ম আত্মপ্রকাশ করে। এতে করে বৈঞ্চবী সাধন পদ্ধতির মধ্যে অনিবার্য রূপে শামিল হয় প্রাচীন মরমীবাদ । ফলে পূর্বরাগ, অনুরাগ, বংশী, বিরহ, দেহকাঁচা ও সোয়া-ময়না সম্মেলিত ইত্যাদি মরমী সাহিত্যের শব্দ, নামে উপনামে বৈঞ্চববাদে বা বৈঞ্চব সাহিত্যে সরাসরি ধার করা হয় । এ ভাবে মরমীবাদের হূদয়স্পর্সী শব্দমালায় রচিত সঙ্গীত বাউল সঙ্গীত নামে আত্মপ্রকাশ করে এক নতুন সম্প্রদায়ের জন্ম দেয়, যা আজকাল বাউল নামে অভিহিত ।
---লালন বলেছেন
করি কেমনে শুদ্ধ প্রেম রসের সাধন
প্রেম সাধিতে কেঁপে ওঠে কাম নদীর তুফান…।
বলবো কী হইলো প্রেমের কথা
কাম হইলো প্রেমের লতা
কাম ছাড়া প্রেম যথা, তথা নাইরে আগমন।
এই মানুষে সেই মানুষকে দেখার কথা বলে বাউলরা দেহের ভিতর দেহাতীতের সন্ধান করেন নরনারীর যুগল সাধনার মাধ্যমে। দেহের সাথে দেহের মিলন না হলে মাধুর্য ভজন হয় না। মাধুর্য ভজন না হলে মানুষ হয়ে জন্মানোর স্বার্থকতা কোথায়? এই হলো বাউলদের মৌল জিজ্ঞাসা। এই জিজ্ঞাসার উত্তর তারা খোঁজেন বিকৃতরুচি কাম সাধনায়। এই কারণে বাউলরা জোড়ে জোড়ে থাকেন। বাউল সাধনা একাকী পুরুষের বা একাকী নারীর সাধনা নয়। একে এক ধরনের পাশ্চাত্যের ‘লিভিং টুগেদারের’ সাথেও তুলনা করা চলে। লালনের ধর্মমতের ‘চারিচন্দ্রভেদ’, ‘ষড়চক্র’, ‘দ্বিদলপদ্ম’, ‘মূলধারাচক্র’, ‘সহস্রদলপদ্ম’, ‘অধর মানুষ’, ‘ত্রিবেণী’, ‘সাধনসঙ্গিণী’, ‘প্রেমভজা’ প্রভৃতি কাম আরাধনার ইঙ্গিতপূর্ণ শব্দের তাৎপর্য জানলে বা শুনলে যে কোনো মানুষের লালনের প্রতি শ্রদ্ধা কমে যাবে।


বাউলদের মধ্যে দুটি শ্রেণি আছে গৃহত্যাগী বাউল ও গৃহী বা সংসারী বাউল। যারা গুরুর নিকট ভেক খিলাফৎ-এর মাধ্যমে দীক্ষা গ্রহণ করে তাদের ত্যাগী বা ভেকধারী বাউল বলা হয়। এই শ্রেণির বাউলরা সংসার ও সমাজত্যাগী। ভিক্ষাই তাদের একমাত্র পেশা। তারা আখড়ায় আখড়ায় ঘুরে বেড়ায় এবং সেখানে সাময়িকভাবে অবস্থান করে। পুরুষরা সাদা লুঙ্গি এবং সাদা আলখাল্লা এবং মহিলারা সাদা শাড়ি পরিধান করে। তাদের কাঁধে থাকে ভিক্ষার ঝুলি। তারা সন্তান ধারণ বা প্রতিপালন করতে পারে না। এ ধরনের জীবনকে বলা হয় ‘জ্যান্তে মরা’ বা জীবন্মৃত। মহিলাদেরকে বলা হয় সেবাদাসী। পুরুষ বাউল এক বা একাধিক সেবাদাসী রাখতে পারে। এই সেবাদাসীরা বাউলদের সাধনসঙ্গিনী।

০০পুরুষ
পুরুষ রতিশাস্ত্ৰ অনুযায়ী পুরুষকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
----চার জাতির পুরুষ হলো
১. শশক জাতীয় পুরুষ
২. মৃগ জাতীয় পুরুষ
৩. বৃষ জাতীয় পুরুষ
৪. অশ্ব জাতীয় পুরুষ
১. শশক জাতীয় পুরুষ:

শশক জাতীয় পুরুষের শরীর কন্দৰ্পের মতো অপরূপ কান্তিবিশিষ্ট ও সুলক্ষণ যুক্ত। এদের দেহ নাতি খর্ব ও নাতি দীর্ঘ হয়ে থাকে। শশক জাতীয় পুরুষ শান্ত, শিষ্ট ও পরোপকার প্রবৃত্তিযুক্ত হয়ে থাকে। পরের উপকারেই তার আনন্দ । তার বচন হয় গম্ভীর, মুখমণ্ডল সদা প্রফুল্ল ও হাস্য-পূর্ণ থাকে। শশক জাতীয় পুরুষের মন সাধারণত কাম-গন্ধহীন হয়ে থাকে। এদের মনে বিন্দু মাত্ৰ পাপ থাকে না। একনিষ্ঠ, উচ্চ মানসিক প্রেম এরা পছন্দ করে। ফলে বিভিন্ন নারীর প্রতি এদের আসক্তি দেখা যায় না। এরা গুরুভক্তি, ধ্যান ও স্ৰষ্টার উপাসনা করতে অত্যন্ত ভালোবাসে।
২•  মৃগ জাতীয় পুরুষ: 
মৃগ জাতীয় পুরুষেরা সাধারণত দীর্ঘাঙ্গ হয়ে থাকে। তাই চলাফেরার ভঙ্গি থেকেও এদের অনেকটা চিনতে পারা যায়।কারণ দীর্ঘাঙ্গ  বলে যখন তারা চলে তখন দেখলে মনে হয় এরা লাফিয়ে চলছে ।এই পুরুষেরা বহুভোজী ও ভোজনবিলাসী হয়। এরা বেশ বলবান হয়ে থাকে। তবে বিশেষ স্থূল হয় না। এরা দিনরাত সংগীতে রত থাকতে ভালোবাসে, দেবতা ও অতিথির সেবা করে। গুরুভক্তি ও স্রষ্টার প্রতি প্ৰেম এদের মধ্যেও দেখা যায়। শশক পুরুষের সঙ্গে এ বিষয়ে মৃগ পুরুষের চমৎকার মিল রয়েছে। কিন্তু শশক পুরুষের থেকে মৃগ পুরুষের বিশেষ পার্থক্য এই যে, শশকের মন যেমন নির্মল ও বিশুদ্ধ হয়, পাপের লেশমাত্র মনে স্থান পায় না, মৃগের ঠিক তা নয়। এরা বাইরে অনেক ধর্মপরায়ণ হলেও অন্তরে কিছুটা কপট থাকে। কিন্তু এদের আচার-আচরণে সেটা সহজে বুঝতে পারা যায় না। মৃগ জাতীয় পুরুষের প্রেমের সঙ্গে কিছুটা কামগন্ধ মেশানো থাকে ! তাই মৃগ জাতীয় পুরুষেরা শশকের চেয়ে একটু বেশি নারীসঙ্গ অভিলাষী হয়।
৩. বৃষ জাতীয় পুরুষ:
বৃষ জাতীয় পুরুষের পা ক্ষুদ্র এবং জিহ্বা বড় হয়ে থাকে। এদের দেহ থেকে গুবকের গন্ধ (সুপারির গন্ধ) বের হয়ে থাকে। এরা অতিরিক্ত মাত্রায় ভোজনপ্রিয় হয়ে থাকে। এরা নির্লজ্জ ও অধাৰ্মিক হয়ে থাকে । কোনো কথা বলতে বা কোনো অন্যায় কাজ করতে এদের কখনো বাধে না । এদের মন সর্বদা পাপে রত থাকে। পাপ প্রবৃত্তি যেন এদের মনের সঙ্গে সব সময় জড়িয়ে থাকে। এরা সব সময় নারী দর্শনে অভিলাষী হয়ে থাকে। শুধু দর্শনে নয়, মনে প্রাণেও এরা নারীসঙ্গ দিবারাত্ৰ কামনা করে। বৃষ জাতীয় পুরুষেরা মৃগ ও শশকের থেকে অনেক বেশি কামপ্রবৃত্তি-পূর্ণ হয়ে থাকে। কামের জন্য এমন কিছু নেই যা এরা করতে পারে না। বৃষ জাতীয় পুরুষেরা রাসভের (গাধার) চিহ্নযুক্ত হয়ে থাকে।
৪. অশ্ব জাতীয় পুরুষ:
অশ্ব জাতীয় পুরুষের দেহ রক্ত বর্ণ হয়। শরীরও খুব স্থূল হয়ে থাকে। এরা দ্রুত চলাচল করতে পারে। এরা অধাৰ্মিক, মিথ্যাবাদী, দুরাচার ও মদন-কাতর হয়ে থাকে। পরনিন্দা, পরিচর্চা করতে এরা ভালোবাসে। এরা ধর্মহীন ও ক্ৰোধপরায়ণ হয়। প্রচুর পান ভোজনে এদের আগ্রহ দেখা যায়। যেকোনো রমণী দেখলেই এরা তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এবং তার সঙ্গকামনা করে। অশ্বজাতীয় পুরুষেরা নিজ স্বার্থসিদ্ধি ও কাম-তৃষ্ণা চরিতাৰ্থ করবার জন্যে সর্বদা লিপ্ত থাকে। এদের রতিশক্তি অন্য তিন জাতীয় পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি হয়।
বাউল-সাধকগণ পুরুষের এসব বৈশিষ্ট্য নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করে থাকেন। চার প্রজাতির পুরুষের বৈশিষ্ট্য নিয়ে লালন সাঁইজির একটি চমৎকার গান আছে। গানটি এরকম
“সবে কি হবে ভাবে ধর্মপরায়ণ ।
যার যে ধর্ম সে তাই করে তোমার বলা অকারণ৷
শশকপুরুষ সত্যবাদী মৃগপুরুষ উৰ্ব্বভেদী অশ্ব বৃষ বেহুশ নিরবধি তাদের কুকর্মেতে সদাই মন৷”
০০নারী

সাধনসঙ্গিনী বাউল সাধনার অন্যতম অনুষঙ্গ। সাধনসঙ্গিনী নির্বাচন করার ক্ষেত্রে বাউলরা নারীর কিছু বৈশিষ্ট্যের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখে। এ ক্ষেত্রে তারা রীতিশাস্ত্ৰে উল্লিখিত নারীর বৈশিষ্ট্যের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে। রতিশাস্ত্রে চার রকমের নারীর কথা উল্লেখ আছে। এই চার জাতির নারীর রাতিপ্রকৃতি ও চরিত্র ভিন্ন ভিন্ন রকমের। কারো সাথে কারো স্বভাবের তেমন মিল নেই। এদের প্রত্যেকের জীবনাচরণ পৃথক পৃথক ধরনের হয়ে থাকে।
------চার প্রকারের নারী হলো
১. পদ্মিনী নারী
২. চিত্ৰিণী নারী
৩. শঙ্খিনী নারী
৪. হস্তিনী নারী
১. পদ্মিনী নারীঃ

পদ্মিনী নারী অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ হয়। এরা সৎপথে থাকতে এবং ধর্ম আচরণ করতে ভালোবাসে। অসাধু কথা বা অসৎ কর্ম এরা একেবারেই পছন্দ করে না। পদ্মিনী নারীরা পরম রূপবতী হয়। তাদের গাত্র থেকে পদ্মফুলের মতো সুন্দর ভ্ৰাণ নির্গত হয়। তাদের নেত্ৰ মৃগের মতো মনোহর, কণ্ঠের মিষ্ট ঝঙ্কার কোকিলের সঙ্গে তুলনা করা চলে। তারা যখন হেঁটে চলে তখন যেন মর্যালের মতো দেখায়। পদ্মিনী নারীর মুখ কমলিনীর মতো সদা হাস্যময়। তারা পরম স্নেহময়ী ও সর্বপ্রকার সুলক্ষণযুক্ত হয়ে থাকে। পদ্মিনী নারীকে শাস্ত্রে সর্বনারীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ অর্থাৎ উত্তম বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
২. চিত্ৰিণী নারী:

চিত্ৰিণী নারীর গুণাবলি অনেকটা পদ্মিনী নারীর মতোই। তবে পদ্মিনীর দেহের চেয়ে তারা একটু বেশি লম্বা হয়। চিত্ৰিণী নারীর দেহও অপূর্ব সুন্দর ও লাবণ্য-মণ্ডিত ! তাদের চিত্ত দৃঢ় অর্থাৎ লোভ ইত্যাদিতে তারা বিগলিত হয় না। চিত্ৰিণী নারী সর্বদা জিতেন্দ্রিয় ও সত্যবাদিনী হয়ে থাকে। তারা সবসময় দেবতা ও গুরুজনদের প্রতি ভক্তি প্ৰদৰ্শন করে থাকে । একমাত্র পতি ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের প্রতি তারা আকৃষ্ট হয় না। প্রলোভন বা প্রচুর অর্থও সচরাচর চিত্ৰিণী নারীর মন জয় করতে বা তাদের বিপথগামিনী করতে পারে না। কামভাব খুব বেশি থাকে না। এই জাতীয় নারীদের। অল্প মিলন বা বিহারেই তারা সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত হয়। তারা সকলের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে ও সকলের প্রতি মিষ্ট বাক্য প্রয়োগ করে। পাপকর্মের প্রতি তাদের মন কখনো আকৃষ্ট হয় না। দয়া, ক্ষমা, সততা এগুলো যেন তাদের অঙ্গের ভূষণ ।
৩. শঙ্খিনী নারী

শঙ্খিনী নারীর দেহ ও প্রকৃতি অন্য প্রকার নারীর থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে থাকে। এদের গাত্র থেকে সর্বদা ক্ষারের গন্ধ অনুভূত হয়। এদের কেশ হয় দীর্ঘ, নাক হয় ঈষৎ উন্নত, তাই এদের দেহ মোটামুটি ভালো হলে বেশ ভালোই দেখায়। শঙ্খিনী নারী হয় ভোজন বিলাসিনী । সবসময় যেন তাদের ক্ষুধার উদ্রেক হয়েই থাকে। তাদের দেহ একটু স্কুল ধরনের হয়। স্তন-দ্বয় হয় উন্নত ও কঠোর। এই জাতীয় নারীদের ধর্মে ততটা মতি থাকে না। ধর্ম আলোচনা বা সৎ কথা এরা ততটা ভালোবাসে না। এরা কু-বুদ্ধিমতী হয়। এরা উচ্চ স্বরে হাস্য করতে ভালোবাসে। সেই হাস্য-ধ্বনিতে যেন গগন-বিদীর্ণ হয়। এরা সর্বদা মদনাতুরা হয়ে কামবশে হাস্য পরিহাস করতে ভালোবাসে। নিজ পতিকে ত্যাগ করে সর্বদা অন্য পুরুষের সঙ্গে মিলন বাঞ্ছা করে। এদের হৃদয় কপটতায় পূর্ণ। নিজের প্রবৃত্তি ও কুমনোভাব এরা সর্বদা মিথ্যা কথার আড়ালে গোঁপন রাখে। এরা নিরন্তর শৃঙ্গারে উন্মত্ত হয়ে থাকে। আর তাছাড়া পাপ কথায় দিনরাত্ৰ কাটাতে ভালোবাসে। দেবতা কিংবা গুরুজনে এদের বিন্দু মাত্ৰ ভক্তি থাকে না।
৪. হস্তিনী নারী:
হস্তিনী নারীর আকার ও আচরণ অন্যসব নারীদের থেকে একেবারে পৃথক। হস্তিনীদের মতোই এই প্রকারের নারী হয় প্রকাণ্ড। অনেক সময় তারা ভীষণভাবে স্কুলাঙ্গী হয়ে থাকে। তাদের অঙ্গে সব সময় যেন মদগন্ধ প্রবাহিত হতে থাকে। এদের মাথায় চুল খুব সামান্য মাত্র থাকে। মুখে মৃদু মৃদু হাসি লেগেই থাকে। চোখ দুটি হয় টকটকে লাল। সেই চোখে এরা সবসময় চারিদিকে তাকিয়ে দেখে । এদের স্তনদ্বয় হয় উচ্চ ও কঠিন এবং স্বর হয় কর্কশ ও গভীর। এরা সামান্য সুন্দরী হয়ে থাকে। কিন্তু দেখতে প্ৰবীণা অর্থাৎ প্রকৃত বয়সের চেয়ে এদের বয়স অনেক বেশি দেখায়। হস্তিনী নারী সর্বদা মদনবিহবলা থাকে ও মদনাবশে নির্লজ্জর মতো আচরণ করে। পুরুষের সংস্পর্শে এদের সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে এবং মন আনন্দ রসে পূর্ণ হয় । হস্তিনী নারী দিবারাত্ৰ শৃঙ্গারে মনোনিবেশ করে। নিজের পতির প্রতি রতি-কামনা ছাড়া অন্য আকর্ষণ বেশি থাকে না। প্রয়োজন হলে নিজের পতি ছাড়াও অপর পুরুষসহ সুখ সম্মিলন করে থাকে। এদের পাপ প্রবণতা অত্যন্ত বেশি । ধর্মকর্ম বা দেব-দ্বিজ-গুরুজনে ভক্তি এদের থাকে না । এ বিষয়ে কেউ তাদের উপদেশ দিলেও ওরা অবহেলায় তা উপেক্ষা করে থাকে। যে সমস্ত নারীরা স্বার্থের জন্য পাপের পথে পা বাড়ায় এবং বিপথগামিনী হয় বা ব্যভিচারিণী হয় তাদের মধ্যে বেশির ভাগ হস্তিনী জাতীয় ও কিছুটা শঙ্খিনী জাতীয় নারী।
ফকির লালন সাঁইজির একটি গানে আছে
“সবে কি হবে ভাবে ধর্মপরায়ণ |
যার যে ধর্ম সে তাই করে তোমার বলা অকারণ৷
চিন্তামণি পদ্মিনী নারী এরাই পতিসেবার অধিকারী। হস্তিনী শঙ্খিনী নারী কর্কশ ভাষায় কয় বচন|”
০০বইঃবাউলকোষ
০০লেখকঃ সৈয়দ জাহিদ হাসান
০০ উইকিপিডিয়া, নেট থেকে পাওয়া তথ্য।

মজার কাহিনী ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

$
0
0

মজার কাহিনী ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর  চেনেন না এমোন মানুষ দুই বাংলায় খুব কমিই আছেন।  তাকে নিয়ে প্রচলিত আছে নানা ঘটনা। এগুলির সত্যতা কতটুকু তা নির্ণয় করা এখন যেমন দুরহ তেমনি  আমরা সাধারনরা কোন মজা করলে যতটা প্রচার পায় তার থেকে বিখ্যাতরা মজা করলে মানুষ যেন তা লুফে নেওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আসল কথা কাহিনী যতনা তার থেকে তা থেকে আর বেশি করে লিখা বা প্রচার হয়ে থাকে। বিখ্যাতরা যা করেন তাই মজার কান্ড। আপনি আমি করলে তা হবে পাগলামী।
অনেক বিখ্যাত ব্যাক্তি আছেন যাদের ব্যাক্তিগত জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনা শুনলে না হেসে পারা যায় না। আসুন তাহলে এবার জেনে নেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কে নিয়ে প্রচলিত মজার কাহিনি-০------
০০০ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
১৮২০–১৮৯১ ৷ মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামে জন্ম। ছাত্রজীবনেই ব্যাকরণ, কাব্য, অলঙ্কার, বেদান্ত, ন্যায় ও জ্যোতিষ শাস্ত্ৰে পাণ্ডিত্য অর্জন করে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি পান। হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ প্রবর্তনে অসামান্য ভূমিকা ছিল তাঁর। বহু বিবাহ রোধেও তিনি সোচ্চার ছিলেন। বর্ণ পরিচয়, বেতালপঞ্চবিংশতি, শকুন্তলা, ভ্ৰান্তিবিলাস তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গদ্যগ্রন্থ।
০০বিদ্যাসাগর চরিত
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মের সময় তার বাবা বাড়িতে ছিলেন না। তিনি পাশের গ্রামে হাটে গিয়েছিলেন। ছেলেকে এই সুসংবাদ জানাতে উৎফুল্ল ঠাকুর্দা ছুটলেন হাটের দিকে। পথিমধ্যে ছেলের সাক্ষাৎ পেয়ে বললেন, আমাদের একটি এড়ে বাছুর হয়েছে। সে সময় বাড়িতে একটি গরু ছিল; তারও দু'একদিনের মধ্যে প্রসবের সম্ভাবনা ছিল বিধায় বিদ্যাসাগরের বাবা সে কথা বিশ্বাস করে বাড়িতে ঢুকেই গোয়াল ঘরের দিকে চললেন। তখন বিদ্যাসাগরের দাদু ছেলেকে থামিয়ে রহস্যের হাসি দিয়ে ওদিকে নয়, এদিকে এসো, আমি তোমাকে এড়ে বাছুর দেখিয়ে দিচ্ছি বলে সূতিকাগৃহে নিয়ে গিয়ে সদ্য জন্ম নেওয়া ঈশ্বরচন্দ্রকে দেখিয়ে দিলেন।
পিতামহদেব পরিহাস করিয়া আমায় এড়ে বাছুর বলিয়াছিলেন। তিনি সাক্ষাৎ ঋষি ছিলেন। তাহার পরিহাস বাক্যও বিফল হইবার নহে। আমি যে ক্রমেই এড়ে গরু অপেক্ষাও একগুয়ে হইয়া উঠিতেছিলাম তাহা বাল্যকাল হইতেই আমার আচরণে বিলক্ষণ আবির্ভূত হইত।”
০০শ্লোক রচনা
বিদ্যাসাগর তখন সংস্কৃত কলেজের ছাত্র। সেদিন ছাত্ররা ক্লাসে পড়ছিল। কাব্যশাস্ত্রের অধ্যাপক জয়গোপাল তর্কালঙ্কার ক্লাসে ঢুকেই ছাত্রদের বললেন, “গোপালয়ে নমোহস্তু তে” বাক্যটি দিয়ে চতুর্থ চরণ একটি শ্লোক রচনা করতে। বিদ্যাসাগর বাক্যটি শুনেই রসিকতা করে বললেন, এক গোপাল তো দেখছি আমাদের সামনেই রয়েছেন, আর এক গােপাল বহুকাল আগে বৃন্দাবনে লীলা করেছিলেন। কোন গোপালের বর্ণনা করব? ছাত্রের এই বুদ্ধিদীপ্ত সঙ্গত প্রশ্ন শুনে অধ্যাপক জয়গোপাল খুশি হলেন। হেসে বললেন, বেশ বৎস, আপাতত বৃন্দাবনের গোঁপালেরই বর্ণনা কর।
০০সরস্বতীর স্তব
আর একবার ওই একই অধ্যাপক সরস্বতী পূজা উপলক্ষে ছাত্রদের একটি শ্লোক লিখতে বললেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লিখলেন
লুচি কচুরী মতিচুর শোভিতং
জিলিপি সন্দেশ গজা বিরাজিতাম
যস্যাঃ প্ৰসাদনে, ফলারমাপ্নুমঃ
সরস্বতী সা জয়তান্নিরূন্তরম।
০০রথ দেখা কলা বেচা
বিদ্যাসাগর তখন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ। সাধারণত তিনি ছাত্রদের শারীরিক শাস্তি দান পছন্দ করতেন না। তিনি প্রায়ই ক্লাস চলাকালীন টহল দিয়ে বেড়াতেন। একদিন দেখলেন, এক অধ্যাপকের টেবিলের উপর একটি বেত রাখা। তিনি অধ্যাপককে আড়ালে ডেকে ক্লাসে বেত নিয়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলেন। অধ্যাপক বললেন, ম্যাপ দেখানোর সুবিধার জন্য ওটি নিয়ে গিয়েছি। বিদ্যাসাগর হেসে বললেন, বুঝেছি, রথ দেখা এবং কলা বেচা দু’টোই হবে। ম্যাপ দেখানোও হবে। আবার প্রয়োজন হলে ছেলেদের পিঠে দু’ঘা বসানোও যাবে। কী বলেন? একথা শুনে অধ্যাপক মাথা হেট করে রইলেন।

০০অবতার
একদিন ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগরের কাছে এক গোড়া ব্ৰাহ্মণ দেখা করতে এসেছেন। সেখানে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের কেউই এই অপরিচিত ব্ৰাহ্মণকে প্ৰণাম করলেন না। এই ব্যবহারে ব্ৰাহ্মণ অপমানিত বোধ করলেন। অপমানের জ্বালা মেটাতে উপস্থিতদের লক্ষ্য করে বললেন, এইসব অর্বাচীনদের মনে রাখা উচিত যে, ব্ৰাহ্মণেরা বর্ণশ্রেষ্ঠ, বেদজ্ঞ। এক সময় তারা দেশ ও ধর্মের কল্যাণ সাধন করেছেন। তারা সব সময় সকলেরা প্ৰণম্য । একথা শুনে বিদ্যাসাগর হেসে বললেন, পণ্ডিত মশাই, শ্ৰীকৃষ্ণ একদিন বরাহরূপ (শূকরের চেহারা) ধরেছিলেন বলেই কী ডোমপাড়ায় যত শূকর আছে, তাদের প্রণাম করতে হবে?
০০মাথা খাওয়া
বিদ্যাসাগরের বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ছোট ছেলে ঈশানচন্দ্র এবং বড় নাতি অর্থাৎ বিদ্যাসাগরের ছেলে নারায়ণকে অত্যাধিক স্নেহ করতেন। ফলে বাড়ির অন্য কেউ তাদের শাসন করার খুব একটা সাহস পেত না। অবস্থা বেগতিক দেখে বিদ্যাসাগর পিতৃদেবের মুখোমুখি হলেন। অনুযোগের স্বরে বললেন, বাবা আপনি না নিরামিষাশী? অথচ আপনি দু’বেলা ঈশান আর নারায়ণের মাথা খাচ্ছেন!
০০স্বৰ্গবাস
কোনো এক সাব-জজ প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর পুনরায় বিয়ে করলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাকে বললেন, তোমার তো মরার পরেই স্বৰ্গবাস!
কেন?
আমরা মরলে কিছুদিন নরক যন্ত্রণা ভোগ করে তারপর স্বর্গে যাব। কিন্তু তুমি এখন নরক ভোগ করবে। ফলে মরার পর সরাসরি স্বৰ্গে যাবে।
০০বই ও শাল
একবার এক সম্রান্ত লোক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন। বিদ্যাসাগরের প্ৰিয় শখ ছিল বই পড়া এবং সেগুলো যত্ন করে। বাধাই করে রাখা। এ কাজে তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয়ও করতেন। ভদ্রলোক বইগুলো দেখে বললেন, এরূপ এত খরচ করে বইগুলো বাঁধিয়ে না। রাখলেও হতো।
কেন? এতে দোষ কী? ঐ টাকায় অনেকের উপকার হতে পারত। বিদ্যাসাগর তামাক খেতে খেতে ভদ্রলোকের শাল। লক্ষ্য করে বললেন, আপনার শালটি চমৎকার। কোথেকে, কত দিয়ে কিনেছেন? শালের প্রশংসা শুনে ভদ্রলোক উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন, শালটি পঁচিশ টাকায় খরিদ করা। বিদ্যাসাগর সুযোগ পেয়ে বললেন, পাচ সিকের কম্বলেও তো শীত কাটে, তবে এত টাকার শালের প্রয়োজন কী? এ টাকায়ও তো অনেকের উপকার হতে পারত।
০০ছাই
ইংরেজ রাজদরবার থেকে বিদ্যাসাগর নতুন উপাধি পেয়েছেন। একথা শুনে এক পল্লীগ্রামের শিক্ষক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসে জিজ্ঞেস করলেন, মশাই, নতুন উপাধিটার মানে কী?
সি-আই-ই ।
তাতে কী হলো?
ছাই! বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ত্বরিত জবাব।
০০পরিবেশন
বিদ্যাসাগর নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতে খুব ভালবাসতেন। অতিথিকে
পরিবেশন করার সময় প্রায়ই বলতেন—
হু হু দেয়ং হাঁ হাঁ দেয়ং দেয়ঞ্চ করকম্পনে
শিরসি চালনে দেয়াং ন দেয়ং ব্যঘ্রঝম্পনে ।
০০মনের ময়নাঃ
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একবার গ্রামের এক স্কুল পরিদর্শনে গিয়েছেন। সেখানে এক মধ্যবিত্ত গৃহস্থের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে খেতে বসে রান্নার বিশেষ প্রশংসা করতে লাগলেন। সে সময় ঐ গ্রামেরই এক ধনী ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনিও পরদিন বিদ্যাসাগরকে নিমন্ত্রণ করে নানারকম চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয় সহকারে আপ্যায়ন করলেন। বিদ্যাসাগর খাচ্ছেন ঠিকই কিন্তু রান্নার প্রশংসা করছেন না দেখে হতাশ ধনী গৃহকর্তা ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, রান্না কেমন হয়েছে? ভালো হয়েছে তো?
ভালোই তবে ময়ান কম হয়েছে।
ভদ্রলোক অবাক, কিসের ময়ান?
বিদ্যাসাগর মুচকি হেসে বললেন, মনের ময়ান।
০০বিষ্ঠা সমাচার
বিদ্যাসাগর একদিন গ্রামের মেঠো পথ ধরে হাঁটছিলেন। পথিমধ্যে সমবয়সী একজন রসিকতা করে বললেন, পণ্ডিত মানুষ, আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটছ। দেখো পায়ে আবার বিষ্ঠা না লাগে!
বিদ্যাসাগর রসিকতার জবাবে বললেন, এ গ্রামে বিষ্ঠা আসবে কোথেকে? এখানে তো দেখছি সবই গোবর।
০০০ব্রিং মাই চাদর
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একদিন ট্রেনে কোথায় যেন যাচ্ছিলেন। সহযাত্রী এক ইংরেজ যুবক বিদ্যাসাগরের বেশভূষা দেখে ভীষণ চটে গেল। বিদ্যাসাগর একসময় বাথরুমে গেলে সাহেব তার ময়লা চাদর জানালা দিয়ে ফেলে দিলেন। ফিরে এসে বিদ্যাসাগর চাদর খুঁজে না পেয়ে সবই বুঝলেন, কিন্তু কিছু বললেন না। কিছুক্ষণ পর ইংরেজ যুবক তাঁর কোটটি রেখে বাথরুমে গেলে বিদ্যাসাগরও একই কাজ করলেন। ফিরে এসে সাহেব নিজের কোটি যথাস্থানে দেখতে না পেয়ে বিদ্যাসাগরকে জিজ্ঞেস করলেন। হোয়ার ইজ মাই কোট?
বিদ্যাসাগর নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিলেন, ইওর কোটি হ্যাজ গান টু ব্ৰিং মাই চাদর।
০০পয়সার গরম


ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর খদ্দরের চাদর পরতেন।শীত বা গ্রীষ্ম যাই হোক না কেন গায়ে শুধু চাদর আর কাঠের খড়ম পরেই সংস্কৃত কলেজে ক্লাস নিতে যেতেন। মাঘ মাসের শীতের সময় প্রতিদিন সকালে এভাবে ঈশ্বর চন্দ্রকে ক্লাস নিতে যেতে দেখে প্রায়ই হিন্দু কলেজের এক ইংরেজ সাহেব যাওয়ার পথে বিদ্যাসাগরকে ক্ষ্যাপানোর জন্য বলতেন, “কি হে,বিদ্যার সাগর, বিদ্যার ভারে বুঝি ঠান্ডা লাগে না তোমার?” বিদ্যাসাগর প্রতিদিন কথা শুনতেন, কিন্তু কিছু বলতেন না। একদিন শীতের সকালে ঠিক একইভাবে তিনি ক্লাস নিতে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে আবার সেই ইংরেজের সাথে দেখা। আবার সেই একই প্রশ্ন। এবার সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বর চন্দ্র তার ট্যামর থেকে একটা কয়েন বের করে বললেন, “ এই যে গুজে রেখেছি, পয়সার গরমে আর ঠান্ডা লাগেনা। এবার হলো তো?”

০০কথার প্যাচ
এক বিয়ে বাড়িতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দেখা হয়ে গেল। বিদ্যাসাগরের পায়ে যথারীতি সেই তালতলার শুড়তোলা চটি। বঙ্কিমচন্দ্র তাই দেখে ঠাট্টা করে বললেন, মহাশয় আপনার চটির শুড় তো বেঁকে ক্রমশ ওপর দিকে উঠছে। শেষ পর্যন্ত আকাশে গিয়ে না ঠেকে!
কী আর করা যাবে বলো! জানোই তো, চটি যত পুরনো হয় ততই বঙ্কিম হয়ে উঠতে থাকে, বিদ্যাসাগর হাসতে হাসতে বললেন।
০০আকার
এক গরিব ব্ৰাহ্মণ বিদ্যাসাগরের কাছে সাহায্যের জন্য এসেছেন। আজ্ঞে আমি পাঠশালায় ছাত্র পড়াতাম। জমিদারের শয়তানিতে চাকরি গেছে। বড়ই দুরাবস্থায় আছি। বিদ্যাসাগর শুনেই বললেন, আপনার যে চাকরি থাকবে না তা দুরবস্থার আ-কার দেখেই বুঝতে পারছি।
০০তুলনা
মাইকেল মধুসূদন দত্তের আর্থিক অনটনের সময় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাকে টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করতেন। একদিন এক মাতাল বিদ্যাসাগরের কাছে সাহায্য চাইতে এলে তিনি স্পষ্ট বলে দিলেন, আমি কোনো মাতালকে সাহায্য করি না। কিন্তু আপনি তো মধুসূদনকে সাহায্য করেন। তিনিও তো মদ্যপান করেন। ঠিক আছে, তুমি ওর মতো ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য লিখে আনো। তোমাকেও সাহায্য করব।— বিদ্যাসাগর শর্ত জুড়ে দিলেন।


০০বিদেশী মাল
একদিন সকালে বৈঠকখানায় বসে লেখালেখি করছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। হঠাৎ সেখানে এসে হাজির হলো পাড়ার এক মাতাল ব্রাম্মন।
ব্রাম্মন -’বাবা দয়ার সাগর বিদ্যাসাগর, গরীব বামুনকে দশটা টাকা দাও, একটু দেশী মাল কিনে খাই।’
বিদ্যাসাগর-’দুর হয়ে যা আমার সামনে থেকে। আমি কোন মাতালকে টাকা দেইনা।’
ব্রাম্মন-’তুমিতো মাইকেল মধু সুদনকে নিয়মিত টাকা দাও। সেই টাকা দিয়ে সে বিদেশী মাল খায় আর আমি দেশী মাল খাবো তাও তুমি টাকা দেবেনা?’
বিদ্যাসাগর-’তোমাকেও দিতুম, যদি তুমি ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যের মত একটা বই লিখতে পারতে!
---------বইঃ ব্লগ, নেট

রোগ- ব্যাধি নিরাময়- ওঝা ও ডাইনি( নেটিভ অ্যামেরিকান সংস্কৃতি)

$
0
0

রোগ- ব্যাধি নিরাময়- ওঝা ও ডাইনি( নেটিভ অ্যামেরিকান সংস্কৃতি)
স্বাস্থ্য এবং নিরাময় :
প্রতিটি সংস্কৃতিতে অসুখ সম্পর্কে নিজস্ব ধারণা তৈরি হয়। নেটিভ সংস্কৃতিতে ব্যাধির ধারণাও অলৌকিক বিষয়ের সঙ্গে জড়িত। সাধারণ গলাব্যাথা বা কানব্যাথা, অম্বল বা পেশি যন্ত্রণা ইত্যাদি ব্যাধিগুলিকে অবশ্য অলৌকিক ভাবা হয় না। যে ব্যাধিগুলি দীর্ঘমেয়াদী এবং পীড়াদায়ক সেইগুলি ওঝা বা গুনিনের সাহায্যে সারানো হয়। মনে করা হয় ওই ওঝা হন বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন। ওঝা এই বিষয়ে যথেষ্ট তালিমপ্রাপ্ত, অভিজ্ঞ ও চিকিৎসাশাস্ত্ৰে পণ্ডিত ব্যক্তি। ওঝাগণ বিভিন্ন ভাবে তাদের শক্তি প্ৰাপ্ত হন। এরা ধ্যান ও স্বপ্ন প্ৰাপ্তির মাধ্যমে আত্মিক জ্ঞান অর্জন করতে পারেন। কেউ আবার কোনো চিকিৎসকের শিক্ষানবিশ সহকারী হিসাবে কাজ শিখতে পারেন। কেউবা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই স্বপ্নাদিষ্ট ও স্বপ্নের মাধ্যমে এই বিদ্যা অর্জন করেন।
ইসাক টেনিস নামক এক গিটসকান (ব্রিটিশ কলম্বিয়া) ওঝার বর্ণনায় জানা যায়, অলৌকিকের সঙ্গে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে কীভাবে চিকিৎসাবিদ্যা তার আয়ত্তে এসেছিল। তার জন্মের তিরিশ বছর পর, সে একদিন পাহাড়ে কাঠ আনতে গিয়েছিল। সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। শেষ কুড়ালটি মারার আগেই অদ্ভুত এক আওয়াজ শোনা গেল। এক বিরাট প্যাঁচা তার কাছে এলো। প্যাচটি তার মুখ ধরে, তাকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে চাইছিল। সে জ্ঞান হারাল। যখন চেতনা ফিরল-দেখল একটা বরফাচ্ছন্ন স্থানে পড়ে আছে। তার মাথা বরফে ঢাকা। মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে সরু পথ ধরে এগোতে থাকল দ্রুত। পথের দুধারের গাছগুলি তাঁর পিছনে হামা দিয়ে ছুটছিল। যেন তারা সাপ। সে তার বাবার কাছে পৌঁছে ঘটনাটি বিস্তারিত ভাবে জানালো। সে খুব শীতার্ত হয়ে পড়েছিল এবং উষ্ণতা নিয়ে তবে শয়ন করতে গেল। সেখানে সে ভয়গ্ৰস্থ হল; মনে হল দুজন ওঝা তাকে শুশ্রূষা করছে। কিন্তু বিষয়টি মনে আছে খুবই অস্পষ্ট। যখন সে তন্দ্ৰাচ্ছন্ন ছিল, একজন ওঝা তাকে বলল, ওদের মতো তাকেও একজন ওঝা হতে হবে। কিন্তু সে রাজি হয়নি, তাই সে তাদের পরামর্শও নেয়নি।
আর একদিন সে শিকারে গেল, নদীর অপর পারে। সে একটি ভালুকের গুহার খোজ করতে গিয়ে দেখল সিডার গাছের মগ ডালে একটি প্যাঁচা বসে আছে।  সে তাকে গুলি করল। সেটি মাটিতে পড়ার পর তুলতে গিয়ে দ্যাখে, সেটি ভোজবাজির মতো উবে গেল। একটা পালকও পড়ে নেই। সে যথারীতি বরফ ভেঙে নদীপার হয়ে গ্রামে ফিরে এল। তার বাবার সঙ্গে দেখা হল। একসঙ্গে বাড়ি ফিরল। তার হৃৎপিণ্ড দ্রুত চলতে লাগল। সে কাপতে লাগল। ঠিক আগের অবস্থার মতন। তার চামড়া যেন ফুটতে শুরু করেছে। এই অবস্থাতেই সে গান শুরু করল। এক স্বতঃস্ফূর্ত মন্ত্রগান আপনা। আপনি গেয়ে চলল। অনেক জিনিস আসতে লাগল তার কাছে, বড়োপাখি, জীবজন্তু। তারা তাকে ডাকছিল। এই স্বপ্ন তখনই হয়, যখন একব্যক্তি ওঝায় পরিণত হয়।
সানাপিয়া একজন কোম্যানচে ওঝা। সে তার বিদ্যা অর্জন করেছিল, মা ও মামার কাছ থেকে। তারা উভয়েই ছিল ঈগল ডাক্তার। যারা ডাক্তারি বিদ্যা অর্জন করেছিল ঈগল আত্মা থেকে। কোম্যানচোদের মধ্যে উত্তরসূরি চিকিৎসক খোঁজা হয়, নিকট আত্মীয় থেকে। সাধারণত মা ও মেয়েতে এই বিদ্যা হাত বদল হয়। সানোপিয়ার বিদ্যা তার আত্মীয়র কাছ থেকে অর্জিত হলেও এর মূল রোগ নিরাময়ের শক্তির উৎস কিন্তু অলৌকিক।
ঈগল-আত্মা, নিরাময়ের সময় দৈব-স্বপ্নে আসে, নানারকম মন্ত্রগান ও জপতপ শেখায়। তাই নিরাময় শক্তির মূল সাফল্য, দৈবশক্তিকেই দেওয়া হয়, ব্যক্তিকে নয়।
কিছু সংস্কৃতিতে মনে করা হয় ব্যাধি হল, ব্যক্তি-বিশেষের অতীত কৃতকর্মের ফল। কোনো ক্ষতিকর ঘটনা বা বস্তুর সংযোগে আসার ফলে বা কোনো আত্মার দেওয়া শাস্তির ফলশ্রুতি হিসাবে ব্যাধি হতে পারে। কিছু সমাজে ক্ষতিকারক মানুষ। ডাইনি বা জাদুবিদ্যাকে ব্যাধি সৃষ্টির জন্য দায়ী করা হয়। কিন্তু সব সংস্কৃতিতে রোগের এই কারণটি খুঁজে বার করা খুব জরুরি। এর মাধ্যমে নিরাময়ের সুবিধা হয়।
কারণটি খোঁজা হলে, ওঝা উৎসব শুরু করে অন্তর্নিহিত কারণগুলিকে দূর করার কাজে। অধিকাংশ সময় রোগ নিরাময় হয়, কিন্তু চিকিৎসা বিফলও হতে পারে। রোগ বেড়ে গিয়ে মৃত্যুও হয়। রোগ না। সারলে বা মৃত্যু হলে এটি ওঝার দক্ষতার ওপর দোষ দেওয়া হয়। হয়তো ওঝার অলৌকিকের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষমতা খুবই দুর্বল প্রকৃতির। তার ফলে রোগ নিরাময় হল না।
ইনুইট বিশ্বাস করে, অলৌকিক যখন বিরক্ত হন বা ক্ষুণ্ণ হন, তখনই অসুখ হয়। যদি যথেষ্ট পরিমাণ শ্রদ্ধা না দেখানো হয় বা গর্ভবতী মহিলা যথাযথ বিধি নিষেধ পালন না করেন তবে অসুখ। মানুষের অসহযোগিতা, তর্ক-প্রবণতা, কিংবা বদ মেজাজ ইত্যাদি স্বভাবের জন্য মানুষ অসুস্থ হতে পারে। যখন সাধারণ চিকিৎসায় কাজ হয় না, তখন ইনুইটরা বলে, তার পূর্বের ব্যবহার সম্পর্কে বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
যদি কোনো রোগীর, কোনো পূর্বকৃত কুকর্মের কথা মনে পড়ে এবং জনগণের সামনে তা স্বীকার করে, ওঝা তাকে কোনো বিধি নিয়ম পালন করার জন্য আদেশ দিতে পারে। কোনো রোগীকে আবার কোনও নির্দিষ্ট খাদ্য থেকে বিরত রাখা হয় বা কোনও নির্দিষ্ট গৃহ সামগ্ৰী বিদূরিত করতে পারে।
ইরোকোয়াগণ মনে করে, অসুখের মূল কারণ হল, মানুষের চিন্তাধারা এবং কার্যাবলী। তারা মনে করে, মানুষের অভ্যন্তরের ইচ্ছেগুলো, তার স্বপ্নের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য মানুষ এই ইচ্ছেগুলো পূরণ করে। যদি মানুষ এই ইচ্ছা পূরণ করতে ব্যর্থ হয় বা অস্বীকার করে তবে সে রোগগ্ৰস্ত হয়। তাই ইরোকেয়া ওঝা, রোগীকে তার স্বপ্নগুলি মনে করতে বলে। অনেক ক্ষেত্রে ইচ্ছেগুলি স্বপ্নের মধ্যে খুবই প্রকটিত হয়ে ওঠে। যেমন কোনও রোগী হয়ত বলল, সে স্বপ্নে কোনো নির্দিষ্ট উপহার পেতে দেখেছে। কোনো আত্মীয় বা বন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছে বা কোনও উৎসবে যোগদান করেছে। যখন এইরূপ হয়, সমাজের সভ্যগণ তাকে সেই উপহারটি দিয়ে তার ইচ্ছাপূরণ করে। বা সেই আত্মীয় বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে দেয়।
অনেক সময় রোগী বুঝতে পারে না স্বপ্নে তার কী ইচ্ছা লুকিয়ে আছে, তখন কোনো বিশেষ ধরনের ওঝা, বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করে আত্মার কাছ থেকে গুপ্ত ইচ্ছাটি সম্পর্কে জানতে চায়। এজন্য তারা জলে বা আগুনে প্রবেশ করতে, উপবাস বা ধ্যানমগ্ন অবস্থাতেও থাকতে রাজি। ইচ্ছেগুলো নানারূপ ধরে দেখা দিতে পারে। ইচ্ছা জানা গেলে, রোগী ও তার পরিবার সেগুলি পূরণ করার চেষ্টা করে।
অনেক দেশজ আদিম জনগোষ্ঠী মনে করে ব্যাধি হল আত্মার নিরুদ্দেশের ফল। ইনুইটরা মনে করে, ঘুমের সময় আত্মা শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। নিদ্রাভঙ্গের আগে তা শরীরে প্রবেশ করে। এর মাঝখানে যদি ডাইনির দ্বারা বন্দি হয় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা হারিয়ে যায়, দেহে আর ফিরতে না পারে, তবে মানুষ ভীষণ ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বে। শেষ পর্যন্ত মৃত্যু মুখে পতিত হবে। এই আত্মা হারানোর উপসর্গ হিসাবে শক্তি-ক্ষয় ক্ষুধা-হীনতা, অনিদ্রা বা হতাশাগ্ৰস্ত ইত্যাদি দেখা যায় ।
এই আত্মা হারানো ব্যক্তি, ‘আঙাকট”’ নামক এক ওঝার সাহায্য নেন। এরা বিভিন্ন নাটকীয় এবং আবেগপূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক ধর্মাচরণ পদ্ধতির সাহায্যে চিকিৎসা করেন। রাতের বেলায় দরজা জানালা বন্ধ অন্ধকার এক বাড়িতে, আলো না জালিয়ে, এই রিচুয়াল শুরু হয়। রোগী মাদুরে শুয়ে থাকে। তার আত্মীয় ও সমাজবন্ধুরা উপস্থিত থাকে।
‘আঙাকট” রোগীর পিছনে একটা জায়গায় বসে, তার এতদিনের অর্জিত বিদ্যার দ্বারা অলৌকিক সাহায্যকারীদের আহ্বান করে। অশরীরী, জীবজন্তু এবং অলৌকিকের সহযোগী আত্মাদের আহ্বান করে। সংগীত ও ড্রাম বাদ্য চলে বেশ কিছুক্ষণ। এরপর সেই ওঝার ভর হয়। এক বিশেষ ভাষায় কথা বলে তারা। বিশেষ ভাষায় সেই আত্মাদের সাহায্য প্রার্থনা করে। আদেশ করে, যেন তারাও সেই ওঝার সঙ্গে মিলে রোগীর আত্মাকে খুঁজে বার করে। এই সময়ে তাদের অনেক দুষ্ট আত্মার সঙ্গে লড়াই করতে হয়। রোগী ও অন্যান্য লোকেরা ওঝাকে দেখে নানারকম চিৎকার, গোঙানি করতে থাকে।
ওঝা, সু-আত্মা ও কু-আত্মার লড়াই শেষে হারানো আত্মাকে উদ্ধার করে রোগীর দেহে ফিরিয়ে দেয়। রোগী একটা আবেগপূর্ণ স্বাস্থ্য লাভ করে। রোগমুক্তি হয় অচিরেই।
অনেক ট্রাইব মনে করে অসুখের মূলকারণ হল কোনো বিদেশি বস্তু যখন মানব শরীরে প্রবেশ করে। এই বস্তুকে খুঁজে বের করলেই রোগ নিরাময় হবে। এই ‘বহিবস্তুগুলো শরীর ও মনের সমন্বয় নষ্ট করে দেয়, যে ভারসাম্যগুলো সুস্বাস্থ্যের সহায়ক। অলৌকিক শক্তি এই শক্তিগুলো মানবশরীরে ঢুকিয়ে দেয়, যথেষ্ট লোকচার পালনে ব্যর্থতা বা আত্মার প্রতি অশ্রদ্ধার শাস্তি হিসাবে। ডাইনিও মানুষের ক্ষতি করার জন্য এইগুলি ছুড়তে পারে।
পশ্চিমাঞ্চল সমতল ভূমির শোশোনে ও কোম্যানচে ওঝা বিভিন্ন পদ্ধতির আশ্রয়ে এই বিদেশি বস্তুকে খুঁজে বের করে, তা নিৰ্গত করে। রোগ সৃষ্টিকারী বস্তু, যেমন ছোট্ট পালক, পাথর কুচি, জন্তুর হাড়ের টুকরো, বা কোনো বিশেষ মন্ত্রপূত তরলবস্তু (আকারহীন)-এই বস্তুগুলি নানারকম উপসর্গের সৃষ্টি করে, কোনও স্থানে প্রচণ্ড যন্ত্রণা, ফুলে ওঠা, অথবা শক্ত হাওয়া ইত্যাদি।। ওঝা প্রথমে সেই স্থানে মালিশ করে এবং তারপর ঠোঁট দিয়ে চুয়ে সেই বস্তুকে বার করে। সেই বস্তুকে তারা অগ্নি বা বিশুদ্ধ স্থানে থুতুর মাধ্যমে ফেলে দেয়।
নাভাহোগণ মনে করে মানুষ অসুস্থ হয়, যখন কোনো ছোঁয়াচে বা সংক্রামক বস্তু, ব্যক্তি বা শক্তির সংস্পর্শে আসে। বিভিন্ন জন্তু ও গাছপালা অসুখেৰ জন্য দায়ী। যেমন ভালুক, সজারু, কায়োটি, ঝুমঝুমি সাপ, পিঁপড়ে, মথ এবং ক্যাকটাস ইত্যাদি। প্রাকৃতিক শক্তির মধ্যে বিদ্যুৎ, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি বিপজ্জনক। নাভাহোদের এই সংক্রমণের তত্ত্ব দাঁড়িয়ে আছে একটি ধারণার ওপর। স্বাস্থ্য নির্ভর করে মানুষের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ভারসাম্যের সংরক্ষণের ওপরে। কিন্তু জীবজন্তু ও প্রাকৃতিক শক্তি এই ভারসাম্যর ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। অবশ্যই তাই রোগ নিরাময়ের পথটি হল, এই সংক্ৰামক বিষয়টিকে দূর করা, শরীরের স্বাভাবিক সমন্বয় ও সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনা।
নাভাহো ওঝা এর জন্য মন্ত্রপাঠ ও গানের আশ্রয় নেয়। এই মন্ত্রগান বিভিন্ন অবস্থার জন্য বিভিন্ন রকম। সংগীত ব্যাধি নিরাময় করে। কারণ তা বিভিন্ন নাভাহো দেবতাকে আকৃষ্ট করে। এই নিরাময় সংগীত দুই, পাঁচ বা নয় রাত্রি স্থায়ী হয়। এক একটি রাত্রি, সূর্যস্ত থেকে আর একটি সূর্যস্ত পর্যন্ত গণনা করা হয়। প্রতিটি গানের সঙ্গে যুক্ত থাকে বিশেষ লোকাচার। প্রথমে গানের সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে স্নান করানো হয়। মন্ত্রপাঠ ও গানের মাধ্যমে নাভাহো দেবতাকে তুষ্ট করা হয়, যাতে তিনি সংক্রামক বস্তুটি দূর করে দেন। নাভাহো ওঝা কিছু বস্তুকে ব্যবহার করে, যার মধ্যে নিরাময় ক্ষমতা আছে। যেমন, পালকের দণ্ড, রঙ করা মন্ত্রকাঠি, আশমানি রঙের অস্বচ্ছ পাথরের টুকরো, ক্রিস্টাল, ভুট্টা আঠা,ভুট্টাপরাগ এবং নানাবিধ ভেষজ ঔষধ। এগুলো রোগীর শরীরে স্পর্শ করানো হয়। এবং নিরাময় শক্তি অনুপ্রবেশ করানো হয়। এ ছাড়া অলৌকিক শক্তিকে আকৰ্ষিত করার জন্য তারা একটি শুকনো অঙ্কন ব্যবহার করে। সেটি হল বালির সঙ্গে নানান প্রাকৃতিক রং মিশিয়ে তৈরি চিত্র। রঙিন বালি মাটিতে ছুড়ে ছুড়ে নানানরকম জটিল আলপনা আঁকা হয়। এর প্রাচীন নকশা হল Holy Peopleএর নকশাকৃতি প্রতিমূর্তি। যখন Dry Painting গুলো সম্পন্ন হয়, রোগীকে ওই চিত্রের মধ্যে একস্থানে বসানো হয়। ওঝা, রোগীর করতল ওষুধ জলে ধুইয়ে দেয়। এরপর সে বালিচিত্ৰ স্পর্শ করে এবং রঙিন বালি তার হাতে লেগে যায়। এরপর ওঝা সেই বালি রোগীর দেহে লেপন করে। চিত্রের বিভিন্ন শারীরিক অঙ্গের অংশগুলি, রোগীর অঙ্গের সেই সেই অংশে বালি লেপন করে। এটি নাভাহো দর্শনের শরীরের প্রতীক। কোনো রোগীর হয়তো কোনো বিশেষ অঙ্গে র যন্ত্রণা হচ্ছে। কিন্তু যেহেতু অসুখের প্রভাব সারা শরীর মনের ভারসাম্য নষ্ট করে, সেইহেতু পুরো শরীরেরই চিকিৎসা হয়। যেহেতু বাহ্যিক পরিবেশও মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করে, তাই প্রাকৃতিক শক্তির ভারসাম্যও রক্ষার চেষ্টা করা হয়। একটি নাভাহো মন্ত্রের অংশ বিশেষ: আমি তোমার জন্য বলি প্ৰস্তুত করেছি আমি তোমার জন্য ধোঁয়া প্ৰস্তুত করেছি
আনন্দপূর্ণ প্রভূত কৃষ্ণ-মেঘ আমি কামনা করি আনন্দপূর্ণ প্রচুর বারিধারা আমি কামনা করি আনন্দপূর্ণ প্রভূত পরাগ আমি কামনা করি আনন্দপূর্ণ প্রভূত শিশির আমি কামনা করি। আর একটি ব্যাধি তত্ত্বে ডাইনি বা জাদুকরের বিষয়টিকে কারণ হিসাবে ধরা হয়। ডাইনি বা জাদুকররা এমন মানুষ, যারা ক্ষতিকারক ম্যাজিক চর্চা করে। কারণ তারা দুষ্ট ক্ৰোধী ও ঈর্ষাপরায়ণ। তারা ম্যাজিকের মাধ্যমে মানুষকে তুক করে। তারা শুধু তাদের শত্রুরই হানি করেন না, ঈৰ্ষা প্রসূত হয়ে, অনেক নিরপরাধ ব্যক্তিকেও তারা তুক করে তথা ক্ষতি করে। প্রতিটি সংস্কৃতিতে ডাইনি সম্পর্কে ভিন্ন মতামত থাকলেও একটি বিষয়ে প্রত্যেকেই একমত, যে ডাইনিরা এই শক্তি অলৌকিকের আরাধনা করে অর্জন করে। তারা ডাইনিবিদ্যা কোনো জাদুকরি (ডাইনি) দের কাছ থেকেও অর্জন করতে পারে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ডাইনিরা গুপ্তভাবে তাদের কাজ চালায়। জুনিদের সমাজে ডাইনিদের বহিষ্কার বা হত্যা করা হয়। ডাইনি বিদ্যায় শুধু ক্ষতিকারক তুকতাকই নয়, এমনকি গুপ্তহত্যা পর্যন্ত করা হয়। তাই জুনিদের সমাজে তা বেআইনি। অনেক সমাজে ডাইনিদের সামাজিক ভাবে গ্রহণ করা হলেও তাদের ডাইনি বিদ্যাকে গভীরভাবে নিষিদ্ধ করা হয় এবং দণ্ডও দেওয়া হয়। কারণ অলৌকিক শক্তির চরিত্র যেহেতু নিরাপদ; তাই ভালো মন্দ দুই কাজেই তাকে লাগানো যায়।
পশ্চিম ওয়াশিংটনের স্নোহোমিশরা বিশ্বাস করে, ওঝারা স্বাস্থ্য ও ব্যাধি দুইএর জন্যই দায়ী। যদি ওঝা (ডাক্তার) কারও ক্ষতি করতে চায়, তারা কোনো বিজাতির বস্তু নিয়ে রোগীর শরীরে ঢুকিয়ে দিতে পারে বা তার জীবনটা টেনে বার করে দিতে পারে। একজন আদিবাসী-লোকের কাছে জানা যায়, এই ওঝারা চুপিসারে ঘুমন্ত মানুষের জীবনটা টেনে বার করে মাথা দিয়ে। এবং কবর খানায় সেটা লুকিয়ে রাখে। অথবা তারা আত্মাটি সিডার গাছের ছাল দিয়ে ঢেকে আগুনের ধোঁয়ায় ঝুলিয়ে রাখে। তাতে রোগী প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে মরতে বসে। অ্যাপাচি-রা মনে করে, ডাইনিরা ব্যাধি ঘটানোর নানা ছল কৌশল জানে। তারা ভালুকের বিষ্টা, সাপের চামড়া, বাজপাড়া গাছের ছোটো কাঠ ইত্যাদি দিয়ে নানারকম বিষ তৈরি করে। এই বিষগুলি ব্যক্তির খাদ্যে বা বাড়িতে ছোড়া হয়, বা ঘুমন্ত অবস্থায় নাকে বা মুখে ঢোকানো হয়। ডাইনিরা নানারকম ক্ষতিকারক মন্ত্রও পাঠ করে। Spirit-এর মতো তারা ব্যক্তির শরীরে কিছু ছুড়তেও পারে। কোনো ব্যাধি এলেই ডাইনিদের সন্দেহ করা হয়। যদি কোনো রোগের নিরাময় প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়, তখনও ডাইনিদের দায়ী করা হয়। বা কোনো পরিবারে যদি হঠাৎ ব্যাধির প্রকোপ বাড়ে ও মৃত্যু হয়, তখনও সন্দেহ বাড়ে। অ্যাপা****ের নিরাময় পদ্ধতিতে তারা তুকতাক উৎখাত করে এবং সুস্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনে।

বিদ্রোহী নেত্রী লাল্লা ফাতিমা না’সোমার

$
0
0

00বিদ্রোহী নেত্রী লাল্লা ফাতিমা না’সোমার, জুরজুরা, আলজিরিয়া00
জুরজুরা আলজিরিয়ার উত্তরে কাবিলিয়া অঞ্চলে একটি পবর্তশ্রেণী । বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা এই পবর্তশ্রেণীর মধ্য দিয়ে হজ্জের উদ্দেশ্যে তিউনিস গিয়েছিলেন।
জুরজুরা বিরঙ্গনা লাল্লা ফাতিমা না’সোমার ছিলেন আলজেড়ীয়াটে ইতালীয়  ঔপনিবেশ শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রথমদিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ একটি নাম।
ফাতিমার জন্ম আনুমানিক ১০ জুলাই ১৮৩০ খ্রি. কাবিলিয়ার প্রদেশের আইন আল হাম্মামের কাছে ওয়ারজা নামে একটি গ্রামে একটি মারবুত (সুফি) পরিবারে। তার প্রকৃত নাম ছিল ফাতেমা সিদ আহমেদ। কিন্তু তার দয়াশীলতা, দৃঢ়চিত্ততা এবং তিনি সামার গ্রামে থাকতেন বলে তার ডাক নাম হয় ন’সোমার । ফাতিমার পিতা সিদি আহমেদ নিকটবতী গ্রাম সোমারের একটি কোরান শিক্ষা স্কুল বা মাদ্রাসা পরিচালনা করতেন। এঈ মাদ্রাসার ছাত্রদের উচ্চস্মরে  বিভিন্ন সুরা তেলাওয়াত করা শুনে সম্পূর্ণ কোরান মুখস্থ করে ফেলেন। তার ঘনিষ্ঠরা বর্ণনা করেন, ফাতিমার স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ এবং তার জন্মগত অনেক গুণাবলী ছিল। ১৬ বছর বয়স হবার পর তার আত্মীয়স্বজন ফাতিমার বিয়ে ঠিক করেন তার মামাত ভাই ইয়াহিয়া ন আত ইবুখাওলেফ-এর সাথে। কিন্তু মাদ্রাসার পাঠ সমাপ্ত না করা পর্যন্ত ফাতিমা বিয়ে করতে রাজি হননি।
১৯ শতকের একজন কাবিলিয়া নারী হিসেবে স্ত্রী এবং মাতার ভূমিকা ত্যাগ করে পুরুষের মতো ধর্মিয় শিক্ষা গ্রহণ করা অত্যন্ত বিরল ঘটনা।
পিতার মৃত্যুর পর তনি তার ভায় সি মোহান্দ তায়েবকে সাথে নিয়ে কোরআন শিক্ষা স্কুলটি পরিচালনা করতে শুরু করেন। শিশু এবং গরিবদের প্রতি তিনি বিশেষ যত্নশীল ছিলেন। তার বিশেষ তির্ক্ষ বুদ্ধি এবং দয়াশীলতা জন্য ফাতিমা কাবিলার এলাকার মধ্যে পরিচিত হয়ে উঠেন। ফরাসি সেনা যখন কাবিলা দখল করেন তখন  ফাতিমা না’সোমার বয়স মাত্র ১৬ বছর । দেশের অন্য সব অঞ্চলের মতো এই এলাকাও প্রচণ্ড যুদ্ধ করার পর ফরাসিরা অধিকার করে । তবে লাল্লা ফাতিমার নেতৃত্বে এর বিরুদ্ধে যে গণপ্রতিরোধ গড়ে ওঠে তা
এই নারী যোদ্ধার সাহসিকতা এবং বীরত্বের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে রয়েছে।
শত্রুরা তাকে জুরজুরার জোয়ান অব আর্ক অ্যাখ্যা দিয়েছিল, তবে ধর্মপ্ৰাণ ফাতিমার কাছে এই তুলনা গ্রহণযোগ্য ছিলনা। অটল ঈমানের জোরে তিনি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে শক্রসেনাদের পিছু হটিয়ে দেন।
১৮৫৪ খ্রি. যখন তার বয়স মাত্র ২৪ বছর, তিনি ফরাসি সেনাদলকে (সংখ্যায় এবং রসদের দিক দিয়ে তার চেয়ে অনেকগুণ শক্তিশালী) উয়েদ সেবাউ নামক একটি স্থানে তার সাহস এবং দৃঢ় সংকল্প মনোভাবের মাধ্যমে একটি শিক্ষা দেন। বিখ্যাত এই যুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধের নেতা এল আমজেদ ইবনে আবদেলমালেক ডাক নাম বোউবাঘা) যখন ফরাসি সেনাদলের কাছে প্রায় হেরে বসেছিলেন, তখন ফাতেমা একদল নারী পুরুষ যোদ্ধার নেতৃত্ব দিয়ে যুদ্ধ জয় করেন। এই বিজয় কাহিনী পুরো কাবিলিয়ায় সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। মসজিদে মসজিদে, জাইয়াতে এবং সব কোরান শিক্ষার স্কুল জুরজুরার বীরাঙ্গনার বিজয়গাথায় মুখরিত হয়ে ওঠে।
ফরাসি জেনারেল র্যা নডন এই পরাজয় সহজভাবে নিতে পারেননি । তিনি আজাজগার অধিবাসীদের বলেন ফাতিমা ন’ সোমারের ঠিকানা সন্ধান দিতে, যাতে তার কাহিনী এবং অপকৰ্ম” এখানেই শেষ করা যায়। কিন্তু অধিবাসীরা তার দূতকে এই বলে বিদায় দেন “ফিরে যাও তার কাছে যে তোমাকে পাঠিয়েছে এবং তাকে বল বিশ্বাসঘাতকতার ভাষা আমাদের কানে পৌঁছে না।” এর উত্তরে জেনারেলের প্রতিক্রিয়া ছিল ‘যেহেতু ওরা আমার আহবানে কর্ণপাত করেনি, আমি ওদের আমার কামানের অ্যাওয়াজ শুনতে বাধ্য করবো ।”
কিন্তু ফাতিমা ন'সোমার হাল ছেড়ে দেননি । আজাজগার পতনের পরও এবং র্যা নডনের সৈন্যদের নিষ্ঠুর দমননীতি সত্ত্বেও তিনি যুদ্ধের জন্য লোকজন সমবেত করে।
জন্য এবং স্বাধীনতার জন্য জেহাদ করুন। এগুলো অপরিবর্তনীয় এবং পবিত্র । এসব ব্যাপারে কোন ছাড় দেওয়া যায় নাম এবং কোন ধরনের দর কষাকষি চলে না।”
তার কঠিন ব্যক্তিত্ব পুরো কাবিলিয়ার অধিবাসীদের মধ্যে প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করে।
যা পরিস্ফুট হয় যুদ্ধে লোকজনের আত্মত্যাগের মাধ্যমে। ইখেরিডেন এবং তাখারিতে শত্রুরা পরাজিত হয় ১৮ জুলাই ১৮৫৪ খ্রি, । শত্রুপক্ষের ৫৬ জন অফিসারসহ মোট ৮০০ জন সৈনিক মারা যায়। ২৬ ডিসেম্বর ১৮৫৪ খ্রিঃ বোউবাঘা নিহত হন। ১৮৫৫ খ্রি.-এর প্রথম দিকে কাবিলিয়ার প্রতিরোধ সংগ্রামের বিভিন্ন গোত্রপতি এবং যুদ্ধের কমান্ডাররা একটি কাউন্সিলের মাধ্যমে সর্বসম্মতিক্রমে ফাতিমা লাল্লা এবং তার ভাইকে যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। জেনারেল র্যা নডন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেন এবং ফাতেমা তা মেনে নেন। যুদ্ধ বিরতিকালীন তিনি সেনাদলের শক্তিবৃদ্ধি করার জন্য পরিকল্পনা করেন। জমি চাষ করা হয় এবং এলাকার বিভিন্ন জায়গায় অস্ত্ৰ কারখানা স্থাপন করা হয়। কিন্তু অন্যান্য যুদ্ধবিরতি চুক্তির মতো ফরাসি পক্ষ এই চুক্তি ভঙ্গ করে আবার শক্তিসঞ্চয় বড় শহরগুলোতে আক্রমণ চালায় । ১৭ মে ১৮৫৭ খ্রি. জেনারেল র্যা নডন আবার শক্তিসঞ্চয় করে ৪৫০০০ সৈন্য নিয়ে কাবিলিয়া আক্রমণ
করেন ।
ফাতিমা আপ্রাণ চেষ্টা করেন শক্ৰদের প্রতিরোধ করতে, কিন্তু বিশাল এই সেনাদল এবং বড় বড় কামানের বিরুদ্ধে শেষপর্যন্ত পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায় ফাতিমা এই যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন এবং নির্দেশ দেন যোদ্ধারা যেন একে অপরের সাথে কোমরে দড়ি বেঁধে রাখে যাতে কেউ পালাতে না পারে। ১১ জুলাই জুরজুরার এক উচ্চ পর্বতের চূড়ায় অবস্থিত এক গ্রাম থেকে তাকে বন্দি করা হয় ।
আরো দুইশতজন নারীসহ তাকে তাবলাতে একটি ডিটেনশন শিবিরে বন্দি করে রাখা হয়। অকুতোভয় সুফি এই মহিয়সী নারী ১৮৬৩ খ্রি. মারা যান। ১৯৯৫ খি, তার দেহাবশেষ রাজধানী আলজিয়ার্সের এল আলিয়া জাতীয় বীরদের সমাধিক্ষেত্রে স্থানান্ত রিত করা হয় ।
https://en.wikipedia.org/wiki/Lalla_Fatma_N%27Soumer

রাজপ্রতিভু নদিরা বেগম

$
0
0

রাজপ্রতিভু নদিরা বেগম (নন্দিরা মোহলারায়িম) কোকান্দ খানাতে(১৭৯২-১৮৪২খ্রি.)
নন্দিরা বেগম ছিলেন কোকান্দ খানাতের শাসক ওমর খানের স্ত্রী।আধুনিক উজবেকিস্তানের ফারগানা উপত্যকার পশ্চিমাংশে কোকান্দ অবস্থিত। মধ্য এশিয়ার একটি অন্যতম প্ৰাচীন শহর কোকান্দের ইতিহাস প্ৰায় ২২০০ বছরের।
১৮ শতকের প্রথম ভাগে আশতারখানিদ খানাতের মাঝে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ফারগানা বোখারা থেকে আলাদা হয়। কোকান্দকে কেন্দ্র করে একটি নতুন স্বাধীন রাজ্য কোকান্দ খানাতে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্ৰথমে ক্ষমতায় ছিল হোজ্জারা, তারপর খান রাজবংশ এই রাজ্য শাসন করে। ১৮ শতকের শেষ ভাগে কোকান্দ খানাতের অন্তভূক্ত ছিল বর্তমান ফারগানা, নামানগান, কোকান্দ, আনদিজান তাসখন্দ, খুজান্দ, কিরগিজস্তান এবং দক্ষিণ কাজাখাস্তান ।
উজবেক গোষ্ঠীর শাহরুখ বি ছিলেন কোকান্দ খানাতের প্রথম শাসক । ১৮০৯ খ্রি. আলিম খানের মৃত্যুর পর তার ভাই ৭ম শাসক ওমর খান (১৮০৯–১৮২২খ্রি.) ক্ষমতা দখল করেন। ওমর খান যখন মারা যান তখন তার স্ত্রী নদিরা বেগমের বয়স ছিল ৩০ বছর। ওমর খানের উত্তরাধিকার ছিলেন ১২ বছরের পুত্ৰ মোহাম্মদ আলি খান (মাদালিহান)। কিন্তু মোহাম্মদ আলি (১৮২২-১৮৪২খ্রি.) নাবালক ছিলেন বিধায় তার মাতা বিশিষ্ট কবি নদিরা বেগম পুত্ৰ সাবালক হওয়া পর্যন্ত রাজ্য শাসন করেন। তিনি তার শাসনকালে কোকান্দে সংস্কৃতি এবং শিল্পকলা বিকাশে প্রভূত অবদান রাখেন। নন্দিরা বেগমের নির্দেশে কোকান্দে একটি সরাইখানা, বাজার, একটি মাদ্রাসা, মসজিদ, হামাম এবং অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। তিনি ১৮২৫ খ্রি. মাদারি-খান নামে প্রধান সমাধিক্ষেত্র স্থাপন করেন উমর খানের মায়ের জন্য। এটি মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের একটি অন্যান্য দৃষ্টান্ত। তিনি ছিলেন একজন সুফি শিক্ষক, গজল রচয়িতা (তিনি তার বাইয়াতে ১০ হাজার পঙক্তি রচনা করেন)। সরাসরি কোকান্দ সরকার পরিচালনা করেন। স্বাধীনতার পর ৭ মে ১৯৯২ খ্রি. উজবেকিস্তানের প্রথম ডাক টিকিট ইসু্য করা হয় উজবেক কবি এবং কোকান্দ খানাতের শাসক নন্দিরা বেগমের (নদিরা মোহলার-ওইম) ২০০তম বার্ষিকীতে এটি উৎসর্গ করা হয় ।
“হে ঋজু হয়ে দাঁড়ানো সাইপ্রেস বৃক্ষ, কি ভাবছো তুমি?
ঠিকানা খুঁজে বেড়াবার তোমার এই সংকল্প আমার হৃদয় জ্বলিয়ে দেয়।
ক্ষমা কর আমাকে, আমি শুধু চেয়েছি তোমার নিখুঁত অবয়ব।
তুমি চাঁদের চেহারা নিয়ে তর্ক কর,
হে, সূর্য তুমি কি রাহুমুক্ত হয়েছে?


আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় বাংলাদেশ

$
0
0

আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় বাংলাদেশ
আলেকজান্ডারের ভারত অভিযান ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এর পূর্ববতী ভারত ইতিহাসের অধ্যায়গুলি খুবই অস্পষ্ট এবং তমসাচ্ছন্ন। আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের পর থেকেই গ্ৰীক ইতিহাসকারগণের বিবরণীতে ভারত তথা বাংলাদেশের রাজবৃত্তের কাহিনী সম্পষ্ট।
খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে আলেকজান্ডার যখন ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন, তখন বাংলাদেশ একটি পরাক্রান্ত রাজ্য ছিল, সমসাময়িক গ্ৰীক লেখকগণের বর্ণনা থেকে তা স্পষ্টই বোঝা যায়। গ্ৰীক লেখকগণ গঙ্গারিডই (Gangaridi) অথবা গন্ডারিডাই (Giandaridi) নামে এক পরাক্রান্ত জাতির উল্লেখ করেছেন। এ জাতি যে বাংলাদেশের অধিবাসী সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এ রাজ্যের যথার্থ অবস্থিতি ও বিস্তৃতি সম্পর্কে সমসাময়িক গ্ৰীক গ্রন্থকারগণ বিভিন্ন বর্ণনা দিয়েছেন। কেউ কেউ গঙ্গানদীকে এ রাজ্যের পূর্ব সীমা ও কেউ কেউ এর পশ্চিম সীমা বলে বর্ণনা করেছেন।
প্লিনি (Pliny) বলেন, গঙ্গা নদীর শেষ ভাগ এই রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
গঙ্গারিডই জাতি সম্পর্কে ডিওডোরাস (Diodorus) এরূপ বর্ণনা দিয়েছেন, “ভারতবর্ষে বহু জাতির বাস। তন্মধ্যে গঙ্গারিডই জাতিই সর্বশ্রেষ্ঠ । এদের চার সহস্ৰ বৃহদাকায় সুসজ্জিত রণহন্তী আছে। এ জন্যই অপর কোন রাজা এ দেশ জয় করতে পারেননি। স্বয়ং আলেকজান্ডারও এই সমুদয় হস্তীর বিবরণ শুনে এ জাতিকে পরাস্ত করার দুরাশা ত্যাগ করেন।”
গ্ৰীক গ্রন্থকারগণ গঙ্গারিডই ছাড়াও প্রাসিঅয় (Prasioi) নামে অপর এক জাতির উল্লেখ করেছেন। প্রাসি অয়দের রাজধানীর নাম ছিল পালিবোথরা (পাটলি পুত্র) । গঙ্গারিডই ও প্রাসিঅয় এই দুই রাজ্যের মধ্যে যথার্থ সীমারেখা জানা যায়নি। টলেমির (Ptolemy) বৰ্ণনানুসারে প্রাসিঅয় রাজ্য গঙ্গানদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং তাম্রলিপ্তি এর অন্তর্ভুক্ত ছিল । সম্ভবত প্রাসিআয়গণ গঙ্গারিডই দেশের পশ্চিমে বসবাস করত। আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় এই দুই জাতির পরস্পর সম্পর্ক সঠিক জানা যায় না। কাটিয়াস (Curtius) এ দুটিকে পৃথক জাতি বলে বর্ণনা করেছেন। ডিওডোরাস (Diodorus) গঙ্গারিডই ও প্রাসি অয়গণকে একটি অভিন্ন জাতি বলে উল্লেখ করেছেন। পুটার্ক (Pluntarch) এক স্থানে এই দুই জাতিকে গঙ্গারিডই রাজার অধীন এবং অন্যস্থানে এদের দুই পৃথক রাজার উল্লেখ করেছেন। পুটার্ক লিখেছেন, গঙ্গারিডই ও প্রাসি অয় রাজাগণ এক বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে আলেকজান্ডারের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। যাহোক, গ্ৰীক লেখকদের বর্ণনার উপর নির্ভর করে এরূপ অনুমান করা যেতে পারে, গঙ্গারিডই ও প্রাসিঅয় এই দুই জাতি একই রাজবংশের নেতৃত্বে যুগভাবে আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে অস্ত্ৰধারণ করেছিলেন। গ্ৰীক লেখকদের বর্ণনার উপর নির্ভর করে এও অনুমান করা যেতে পারে, আলেকজান্ডারের আক্রমণের সময় বাংলার রাজা মগধাদি দেশ জয় করে পাঞ্জাব পর্যন্ত স্বীয় রাজ্য বিস্তার করেছিলেন এবং তিনি ছিলেন পাটলি পুত্রের নন্দবংশীয় কোন রাজা ।
আলেকজান্ডার বিপাশা নদীর তীরে এসে উপস্থিত হলে সংবাদ পান, গঙ্গারিডই ও প্রাসি অয় রাজ্যের রাজা অথবা রাজাগণ এক বিরাট সৈনাবাহিনী নিয়ে তাকে বাধা প্ৰদান করতে প্ৰস্তুত হয়ে আছেন। এ সংবাদে গ্ৰীক সৈন্যগণ ভীত হয়ে আর অগ্রসর হতে চাইল না । অগত্যা দ্বিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডারকে বিপাশা নদীর তীর থেকে স্বদেশাভিমুখে প্রত্যাবর্তন করতে হয়। এটি সত্য, আলেকজান্ডারের আক্রমণের সময় পাটলিপুত্রে নন্দবংশীয় রাজা রাজত্ব করছিলেন। জৈন পরিশিষ্ট পার্বণে নন্দবংশীয় রাজাকে নাপিত কুমার’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নন্দরাজা বাঙালি ছিলেন কিনা সে সম্বন্ধে সঠিক কিছু জানা যায়নি। কিন্তু এ সময় যে বাংলার রাজাই সমধিক শক্তিশালী ছিলেন প্রাচীন গ্ৰীক লেখকগণের উক্তি থেকে তা নিঃসন্দেহে প্ৰমাণিত হয় ।
00আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের অব্যবহিত পরে বাংলাদেশ
আলেকজান্ডারের প্রত্যাবর্তনের পর চন্দ্ৰগুপ্ত-মৌর্য উত্তর-ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের উপর মৌর্য বংশের প্রভুত্ব স্থাপন করেন। গ্ৰীক ও বৌদ্ধ গ্রন্থকারদের বর্ণনানুসারে গাঙ্গেয় উপত্যকা ও উত্তরবঙ্গে মৌর্য শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কয়েকটি সূত্রের উপর নির্ভর করে বলা যায়, বাংলা মৌর্য সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল।
কাটিয়াস-এর মতে, গঙ্গারিডই রাজ্যটি মগধের রাজা এ্যাগ্রামেস বা ধনানন্দের সাম্রাজ্যের অন্তভুক্ত ছিল। সুতরাং এটি অনুমান করা যেতে পারে, চন্দ্ৰগুপ্ত-মৌর্য মগধের নন্দ বংশের সিংহাসন দখল করলে বাংলাদেশ স্বাভাবিকভাবেই মৌর্য সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।
দ্বিতীয়ত, হিউয়েন সাং বাংলাদেশকে অশোকের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রদেশ উল্লেখ করেছেন। তিনি তাম্রলিপ্তি, কর্ণসুবর্ণ ও সমতট অশোকের বহু স্তম্ভের ধ্বংসাবশেষ লক্ষ্য করেছিলেন।
তৃতীয়ত, উত্তর বঙ্গের বগুড়া জেলার মহাস্থান গড়ে প্রাপ্ত ব্ৰাক্ষী ভাষায় উৎকীর্ণ শিলালিপি থেকে বাংলাদেশের উপর মৌর্য শাসনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এই লিপিতে পুণ্ডবর্ধন নগরীর সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধির কথাও উল্লেখিত হয়েছে এবং এর শাসন ব্যবস্থাও ছিল উন্নত।
মৌর্য সামাজ্যের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস তমসাচ্ছন্ন। মহাস্থান গড়ে শূঙ্গ যুগের কয়েকটি পোড়ামাটির মূর্তি ও নোয়াখালীতে প্রাপ্ত কয়েকটি শিলালিপি থেকে জানা যায়, মৌর্য বংশের পতনের পর শৃঙ্গ বংশের রাজত্বকালে বাংলার রাজনৈতিক জীবন স্থিতিশীল ছিল। এই যুগেও পুণ্ডবর্ধন নগরের সমৃদ্ধি অব্যাহত ছিল।
বাংলাদেশের কোন অংশ কুষাণ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত ভাবে কিছু জানা যায় না। বাংলা ও উড়িষ্যায় কুষাণ রাজাদের মুদ্রা পাওয়া গেছে। এতে কেউ কেউ ধারণা করেন, বাংলাদেশ কুষাণ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল।
  কিন্তু ডঃ মজুমদার একে নিশ্চিত প্ৰমাণ বলে গ্ৰহণ করেননি। তাঁর মতে, কোন রাজা বা রাজবংশের মুদ্রগুলি অনায়াসেই নানা কারণে ভিন্ন রাজ্যে নীত হয়ে থাকে। সুতরাং কেবল মাত্র মুদ্রার উপর ভিত্তি করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত করা সম্ভব নয়। মুদ্রা বাণিজ্যের মাধ্যমে স্বরাজ্য সীমা পার হয়ে অন্যস্থানে যেতে পারে।
টলেমির (Ptolemy) রচনা ও পেরিপ্লাস (Periplus) নামক গ্রন্থে খ্রিস্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চল নিয়ে এক শক্তিশালী রাজ্য গঠিত ছিল বলে উল্লেখ আছে। এই রাজ্যের রাজধানী শহর গঙ্গে (Gange) একটি প্রসিদ্ধ বন্দর ছিল। বাংলায় যে সূক্ষ্ম মসলিন তৈরি হত তা এই বন্দর থেকেই সুদূর পশ্চিম দেশে রপ্তানি করা হত। এই নগরের কাছেই সোনার খনি ছিল।
  ডঃ নীহার রঞ্জন রায়ের মতে, বাংলার সুবৰ্ণ বীথি ও সুবৰ্ণ গ্রামের উল্লেখ থেকে মনে করা হয়, বাংলায় সোনার খনি ছিল। পেরিপ্লাস গ্রন্থে নিম্ন গাঙ্গেয় ভূমিতে ‘ক্যালটিস’ নামক এক প্রকার স্বর্ণ মুদ্রা প্রচলনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
ফরিদপুর জেলার কোটালি পাড়া অঞ্চলে প্রাপ্ত ষষ্ঠ শতকের একটি সুবৰ্ণ বীথির উল্লেখ, ঢাকা জেলার সুবর্ণ গ্রাম, সোনারঙ্গ এবং সোনাকান্দি প্রভৃতি সকল নামই সুবর্ণ স্মৃতি বহন করে। তাই বলা চলে টলেমির উল্লেখিত সোনার খনি নেহ্যায়েত কাল্পনিক না-ও হতে পারে।
কুষাণ যুগের পর থেকে গুপ্ত যুগের সূচনা পর্যন্ত বাংলার ইতিহাস এখনও অন্ধকারে আছে। তবে প্রাপ্ত উপাদান সমূহে বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ও বিস্তৃত ব্যবসা-বাণিজ্য ও তার ফলস্বরূপ বাংলার সমৃদ্ধির সুস্পষ্ট আভাস রয়েছে। ভবিষ্যতে আরও তথ্য উদঘাটন হলে এই অন্ধকার অংশ আরও আলোকিত হতে পারে।

০০বাংলাদেশের ইতিহাস পরিক্রমা—কে এম রাইছ উদ্দিন

বাংলার মুসলমানদের অবনতির কারণ

$
0
0

বাংলার মুসলমানদের অবনতির কারণ

00হাণ্টারের মতে বাংলার মুসলমানদের অবনতির কারণ ছিল নিম্নরূপ :
ক. রাজ্য হারিয়ে মুসলমানরা সকল প্রকার রাষ্ট্ৰীয় সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে; এর পিছনে ব্রিটিশ সরকারের নীতি কাজ করেছে।
খ, শাসকশ্রেণী হিসাবে নিম্ফল অহংকার, যার ফলে পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে খাপখাওয়াতে পারেনি।
গ. রাজভাষা ইংরাজি শিক্ষা না করায় তারা সরকারি সওদাগরি চাকরির সুযোগ হারিয়েছে। ঘ, ধনীদের কাছে থেকে উৎকোচ, ভেট, অত্যধিক কর নিয়ে ইংরাজরা মূলধন আত্মসাৎ করেছেন। ফলে তারা দরিদ্র-দশায় পতিত হয়েছে।
ঙ.প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়ে বাঙালি হিন্দুদের কাছে পরাজিত হয়েছে।
চ. জনশিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মশিক্ষার স্থান না থাকায় তারা আধুনিক শিক্ষা গ্ৰহণ করতে অনিচ্ছুক হয়েছে। The Indian Mussalinans, See chapter 4.
00সৈয়দ আমীর আলী “স্মারকপত্রে (১৮৮২) বলেছেন, ইংরাজ কোম্পানির দেওয়ানি রাজস্বনীতি ও লর্ড বেণ্টিঙ্কের শাসননীতির ফলে ভূসম্পত্তি, রাজস্ববিভাগ ও বিচার বিভাগের চাকুরি থেকে বঞ্চিত হয়ে মুসলমান সম্প্রদায় চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পতিত হয়। একাধারে দারিদ্র্য ও অন্যধারে সরকারের শিক্ষানীতির ফলে মুসলমানরা আধুনিক শিক্ষা গ্রহণে ব্যর্থ হয়। ফারসি রহিত করা হয় বটে, কিন্তু ইংরাজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়নি। ১৮৬৪ সাল পর্যন্ত মুন্সেফগিরি ও উকিলগিরি পরীক্ষা উর্দু অথবা ইংরাজিতে দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। ফলে ইংরাজি শিক্ষার তাগিদ কমই ছিল। ইংরাজি ভাষা ও আধুনিক শিক্ষার অভাবে চাকুরির ক্ষেত্রে অন্য সম্প্রদায়ের সহিত প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেনি তারা ; কোন কোন ক্ষেত্রে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আমলাদের ষড়যন্ত্রের ফলে চাকুরি লাভে বঞ্চিত হয়। Mentorial of the National Mahoneclan Association, Calcutta, 1882.
00 খোন্দকার ফজলে রাবিব “দি অরিজিন অব মহামেডানস অব বেঙ্গল’ (১৮৯৫) গ্রন্থে মুসলমানদের পশ্চাদপদতার কারণ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, ইংরাজি ভাষার প্রবর্তন ও সেই ভাষার বিরুদ্ধে অন্ধভাবে পোষিত মুসলমানদের কুসংস্কার এবং সরকারি চাকুরির নতুন বিবিধব্যবস্থায় পূর্বের পদমর্যাদা থেকে অপসারণের ফলে তারা দারিদ্র্য ও বিস্মৃতির গহবরে নিমজ্জিত হয়েছে।
The Origin of Mahoneclans of Bengal. Calcutta. 1895





‘মোসলেম ক্রনিকলে জনৈক প্রবন্ধলেখক মুসলমানদের পতনের কারণ ব্যাখ্যা করেন। এভাবে :
ক. মুসলমানরা রাজ্য হারিয়ে “ভাববাদী হয়ে ওঠে, তারা অতীতের ঐতিহ্যের দিকে তাকিয়ে থাকত এবং গৌরবের কথা ভেবে দুঃখ প্রকাশ করত ; ইংরাজদের প্রভু বলে স্বীকার করতে পারেনি, ফলে যুগের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে দেরি হয়ে যায়।
খ. চাকুরি-বাকরী হারিয়ে যারা কৃষিকাৰ্য গ্রহণ করেছিল, তারা অদক্ষতার কারণে কৃষিতে উন্নতি করতে পারেনি।
গ. অর্থকরী ব্যবসায়ে তারা অমনােযোগী ছিল। সুদের ব্যবসায় 'হারাম" (নিষিদ্ধ) বলে মহাজনী করতে বিরত হয়।
ঘ. বিলাসিতা ও অমিতব্যয়িতার জন্য গরীব হয়ে পড়ে।
ঙ. ইউরোপীয় বিদ্যা ও বিজ্ঞান শিক্ষা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা ছিল, ফলে আধুনিক শিক্ষা থেকে দূরে থেকে দুভাগ্যকে ডেকে আনে।
চ. সুবিধাপ্রাপ্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছ থেকে সহানুভূতি লাভে ব্যর্থ হয়েছে। The Moslem Chronicle, 23 May 1896 (Supplementary).

দেলওয়ার হোসেন আহমদ ‘ল অব সাকসেশন" শীর্ষক একটি প্রবন্ধে মুসলমানের উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তি বণ্টনের ফলে সমাজ দরিদ্রে পরিণত হয় বলে উল্লেখ করেন। এবং ঐ আইনের সংশোধনের পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। একিনুদ্দীন আহমদ ও কতিপয় লেখক ঐ মতের বিরোধিতা করেন এবং সম্পত্তি বাড়াতে না পারা মানুষেরই অক্ষমতা — এই যুক্তিতে শাস্ত্রীয় আইনের অভ্রান্ততা প্রতিপন্ন করেন। The Moslem Chronicle, 23 May 1896 (Supplementary).
“হিন্দু মোসলমান (১৮৮৮) পুস্তকে শেখ আবদোস সোবহান বাংলার মুসলমান জমিদারদের পতনের কারণ হিসেবে তাঁদের বিলাসিত, ভৌগলিপসো, দায়িত্বহীনতা ও শিক্ষার প্রতি অমনোযোগিতার কথা বলেছেন। আমলার উপর জমিদারির দায়িত্ব দিয়ে মাসোহেব-চাটুকার পরিবৃত হয়ে বাইজী-বেশ্যা-খেমটা, গাচ-গানে অথবা মোরগ-লড়াই, কবুতর উড়ান ইত্যাদি কুক্রীড়ায় কালাতিপাত করেন। তাঁরা আধুনিক শিক্ষা ও যুগের দায়িত্ব সম্পর্কে উদাসীন। তাঁদের অযোগ্যতার ও অকৰ্মণ্যতার সুযোগ নিয়ে অসৎ আমলারা জমিদারি উৎসন্নে দেয়। তিনি মুসলমান জমিদারদের উপদেশ দিয়ে বলেছেন, আছে ? ... মোরগ লড়াই কবুতর উড়ান ইত্যাদি কুক্রীড়া সকল ত্যাগ করুন। জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হইবে, বুঝিতে পরিবেন, আপনি এত ঋণী কেন। ... গাঁজা, আফিম, মদ, বেশ্য যদি কিছু অভ্যাস করিয়া থাকেন, শীঘ শীঘ্ৰ ত্যাগ করিয়া, বিষয় কাৰ্য্যে মন দিউন, অশিক্ষিত মুখ মদ্যপায়ী, বিলাসী, লম্পট, মাসোহেব ইয়ার, পূর্ণ অসভ্য, পূর্ণ চাষা,খানসামা, খেদমতগার লাঠিয়াল ত্যাগ করুন।
সূত্রঃ উনিশ শতকে বাঙালি মুসলমানের চিন্তা ও চেতনার ধারা—ওয়াকিল আহমদ

দারুল ইসলাম এবং হারব নিয়ে প্রাচীন তিন ফতোয়া

$
0
0

****দারুল ইসলাম এবং হারব নিয়ে প্রাচীন তিন ফতোয়া




মক্কা শরীফের মুফতীগণের ফতোয়া
(তিনটি মুসলমান মযহাবের প্রধানগণ) সওয়াল:
(আপনাদের মহিমা অনন্ত হোক) এই সওয়ালের আপনাদের জওয়াব কি: হিন্দুস্তান দেশটার শাসকরা খ্ৰীষ্টান, তারা ইসলামের সব বিধানের উপর, যেমন প্রাত্যহিক নিয়ম মুতাবেক নামায, দুই ঈদের নামায প্রভৃতিতে হস্তক্ষেপ করে না; আবার কোনো কোনো বিধান লঙঘনের অনুমতিও দেয়, যেমন, কেউ পূর্বপুরুষের ধর্মত্যাগ করে খ্ৰীষ্টান হলেও তার পূর্বপুরুষ মুসলমানের ওয়ারীশ হয়; এরকম দেশ দারুল-ইসলাম কি না? সওয়ালের জওয়াব দিন। আল্লাহ আপনাদের পুরস্কৃত করবেন।
০০এক নম্বর জওয়াব:
সব প্রশংসাই সর্বশক্তিমানের, তিনি সকল সৃষ্টির প্রভু। হে সৰ্বশক্তিমান! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করো। − যতদিন সেখানে ইসলামের কোনও বিশিষ্ট আচার-অনুষ্ঠান পালিত হবে, ততদিন সেটা দারুল-ইসলাম । আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, মহাপবিত্র ও মহামহিমময়।
এই ফতোয়া দিচ্ছে একজন, যে আল্লার গুপ্ত অনুগ্রহের ভিখারী, আল্লার প্ৰশংসাবাদী এবং তাঁর রসুলের উপর অনন্ত শান্তি ও আশীষ প্রার্থনাকারী।
(স্বাক্ষর)
জামাল ইবনে আবদুল্লাহ শেখ ওমারুল হানাফী';
মক্কাশরীফের বর্তমান মুফতী ।
আল্লাহ্ তাঁর উপর ও তাঁর পিতার উপর কৃপা করুন।
০০০দুই নম্বর জওয়াব:
সব প্রশংসাই আল্লার, তিনি অদ্বিতীয়। আল্লার আশীষরাজি আমাদের রাসুলের উপর, তাঁর বংশধরদের ও সাহাবাদের উপর এবং সব মুসলমানের উপর বর্ষিত হোক । হে আল্লাহ! সৎপথে তোমার দিশা প্রার্থনা করি! হাঁ! যতদিন সেখানে ইসলামের কোনও আচার-অনুষ্ঠান পালিত হবে, ততদিন সেটা দারুল-ইসলাম ।

আল্লাহ সর্বজ্ঞ, মহাপবিত্র ও মহামহিমময়। এর লেখক করুণাময় আল্লার নিকট মুক্তির ভিখারী। আল্লাহ তাঁকে, তাঁর পিতামাতাকে, শিক্ষকগণকে, ভাই-বেরােদরকে, বন্ধুবান্ধবকে ও সকল মুসলমানকে মাফ করতেন ।
(স্বাক্ষর)
আহমদ ইবনে যায়নী দহলান;
মক্কাশরীফের শাফেয়ী মযহাবের মুফতী ।
০০০তিন নম্বর জওয়াব:
সব প্রশংসাই আল্লার জন্য, তিনি অদ্বিতীয়! হে সর্বশক্তিমান! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করো। দাসোকীয় তফসীরে লেখা আছে যে, দারুল-ইসলাম কফিরের হাতে চলে যাওয়ার সংগে সংগেই দারুল-হরাব হয়ে যায় না; তা হয় যখন সব কিংবা অধিকাংশ ইসলামের বিধিবিধান সেখানে রদ হয়ে যায়। আল্লাহ সর্বজ্ঞ। আল্লার আশীষ রাশি আমাদের নায়ক হযরত মুহম্মদ, তাঁর বংশধরদের ও সাহাবাদের উপর বর্ষিত হোক ।
(স্বাক্ষর)
হোসাইন ইবনে ইবরাহিম;
মক্কাশরীফের মালোকী মযহাবের মুফতী ।
০০০দ্বিতীয় পরিশিষ্ট
উত্তর ভারতের আলেম সমাজের ফতোয়া
সৈয়দ আমীর হোসেন, ভাগলপুর বিভাগের কমিশনার সাহেবের খাস মুনশী কর্তৃক ‘ইসতিফতা” বা সওয়ালের তরজমা:
ওলামায়ে দ্বান! ইসলামের আইনের ব্যাখ্যাকর্তাগণ! নিচের সওয়ালের আপনাদের কি ফতোয়: হিন্দুস্তানে জিহাদ কি আইনসংগত? এ দেশটা আগে মুসলমানদের শাসনে ছিল, কিন্তু এখন খ্ৰীষ্টান সরকারের ক্ষমতাধীনে এসেছে। কিন্তু খ্ৰীস্টান শাসন মুসলমান প্রজাদের ধর্মীয়বিধি-বিধানে কোনোরকম হস্তক্ষেপ করে না; যেমন, নামায, রোযা, হজ, যাকাত, জুমার নামায ও জামাতে বাধা দেয় না; বরং তাদেরকে এসব পালনে পূর্ণ স্বাধীনতা ও আশ্রয় দেয়, ঠিক যেমন একজন মুসলমান শাসকও দিয়ে থাকে; সেখানে মুসলমানদের বর্তমান শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার কোনও শক্তি নেই; অন্যপক্ষে যদিও তারা এরকম যুদ্ধ করে, তাহলে তাদেরই পরাজিত হওয়ার এবং তার ফলে ইসলামেরও অযথা অপমানিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। আপনারা উপযুক্ত নয়ীর দিয়ে জওয়াব দান করে সরফরাজ  করুন। ফতোয়ার তারিখ ১৭ই রবিউস-সানী,১২৮৭ হিজরী, মুতাবেক ১৭ই জুলাই, ১৮৭০ খ্ৰীস্টাব্দে।





০০উত্তরঃ
মুসলমানরা এখানে খ্ৰীষ্টানদের নিকট আশ্রয় পেয়ে আসছে; আর যে দেশে আমান থাকে, সে দেশে জিহাদ থাকে না; কারণ জিহাদের সবচেয়ে দরকারী শর্ত হলো, মুসলমান ও কাফেরদের মধ্যে আমান অর্থাৎ আযাদী থাকবে না। এ শর্ত এখানে নেই। তাছাড়া আরও শর্ত এই যে, মুসলমানদের জয়ে ইসলামের মহিমা বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকা উচিত। যদি সেরূপ কোনো সম্ভাবনা না থাকে তাহলে জিহাদ হয় বে আইনী ।
অতঃপর মওলবী সাহেবান ফতোয়ার পোশকতায় মানহায-উল-গাফফার ও ফতোয়া-ই-আলমগীরী থেকে মূল বচন উদ্ধৃত করেছেন।
>>মোহর চিহ্নিত করা
মওলবী আলী মোহাম্মদ লখনবী
মওলবী আবদুল হাই লখনবী
মওলবী ফযলুল্লাহ লখনবী
মওলবী মোহাম্মদ নয়ীম লখনবী
মওলবী রাহমাতউল্লাহ লখনবী
মওলবী কুতব-উদ-দীন দেহলবী
মওলবী লুতফুল্লাহ রামপুরী
এবং আরও অনেকে ।

তৃতীয় পরিশিষ্ট
০০কলকাতা মোহামেডান সোসাইটির ফতোয়া
উত্তর-ভারতের আলেম-সমাজের ফতোয়ার বিরুদ্ধে মওলবী কেরামত আলী ঘোষণা করেন, ভারত দারুল-ইসলাম। অতঃপর তিনি বলেন: “দ্বিতীয় সওয়াল হলো এ দেশে জিহাদ করা জায়েয বা আইন সংগত কিনা । এর জওয়াব প্রথম সওয়ালেই দেওয়া হয়ে গেছে। কারণ, দারুল ইসলামের জিহাদ করা কখনও আইনসংগত হতে পারে না। এই উক্তি এতোই পরিচ্ছন্ন যে, এর পোষকতায় কোনাে যুক্তি বা নষীরের দরকার করে না। এখন যদিও কোনাে বিপথগামী দুৰ্বত্ত ভাগ্যের ফেরে এদেশের শাসক-গোষ্ঠির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তাহলে সে যুদ্ধকে বিদ্রোহ বলে ঘোষণা করা আইনসংগত হবে, আর বিদ্রোহ শরীয়তে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হয়েছে। অতএব এরকম যুদ্ধ হবে বে-আইনী। আর কেউ যদি এরকম বিদ্রোহ ঘোষণা করে, তাহলে মুসলমান প্রজাদের কর্তব্য হবে শাসকদেরকে সাহায্য করা এবং শাসকদের সহযোগিতায় বিদোর্থীদের সঙ্গে যুদ্ধ করা। ফতোয়া-ই-আলমগীরীতে ঠিক এভাবে সু স্পষ্ট বলা হয়েছে।
......এই বিষয়ে আরো পড়তে-----
দারুল ইসলাম ও দারুল হরব কাকে বলে? বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হুকুম কি?

http://www.somewhereinblog.net/blog/fay … w/29900982


#প্রশ্ন - দারুল হরব কাকে বলে? বাংলাদেশ কি দারুল হারব?
https://web.facebook.com/PleaseGivePeac … 1&_rdr
হিন্দুস্থান কি ‘দারুল ইসলাম’, না ‘দারুল হারব’?

https://mishukifti.wordpress.com/2014/1 … দারুল-ইসল/
দারুল ইসলাম এবং দারুল হারব
https://alihasanosama.com/islamic-political-science-1/

গো-হত্যা--হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব-বিভেদের ঐতিহাসিক পর্যালোচনা

$
0
0

গো-হত্যা--হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব-বিভেদের ঐতিহাসিক পর্যালোচনা (প্রথম পর্ব) 

হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিভেদের কতগুলি কারণ আছে, সেগুলির মধ্যে গো-হত্যার ও গো-রক্ষার সমস্যাটি ছিল সবচেয়ে স্পর্শকাতর এবং সব চেয়ে মারাত্মক। গোহত্যিা নিয়ে দাঙ্গা, খুন, মোকদ্দমা সবই সংঘটিত হয়েছে। মুসলমানরা গো-হত্যা করে ও গো-মাংস ভক্ষণ করে। তারা ঈদুল আজহা’ বা কোরবানি উৎসবে ছাগ, মেষ, মহিষ, উট, দুষ্কবার সঙ্গে গরু ও কোরবানী করে। (১ ‘কোরবানী" (আরবি কুর্বনি) শব্দের অর্থ উৎসর্গ ; হজরত ইব্রাহিম ঈশ্বরের নিকট স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে নিজ পুত্র ইসমাইলকে উপাস্যের নামে কোরবান করতে উদ্যত হলে ঈশ্বরের মহিমায় তার প্রাণ রক্ষা পায়, ইসমাইলের পরিবর্তে দু'বা জবেহ হয়। সেই ঘটনার পর থেকে কোরবানির রীতি চলে আসছে; হজরত মহম্মদ একে ইসলাম ধর্মের অঙ্গীভূত করেন।)

এটি ধর্মপালনের অঙ্গ ; তবে ধর্মোৎসব ছাড়াও বিবাহাদি সামাজিক উৎসবে এবং উৎসব ব্যতিরেকে গো-মাংস ভক্ষণ উদ্দেশ্যে মুসলমানেরা গরু হত্যা করে থাকে। এদিকে হিন্দুগণ গরুকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করে, সেই সূত্রে তাদের কাছে গো-হত্যা মহাপাপ।। (২ বেদে বা উপনিষদে গোহত্যা ও গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ নয়। প্ৰাচীন আৰ্য সমাজে গোমাংস দ্বারা অতিথি আপ্যায়নের রীতি ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে হিন্দু সমাজে গোহত্যা ও গোমাংস নিষিদ্ধ নয়। পুরাণে আছে, পৃথু বা বিশ্বপতির নির্দেশে পৃথিবীর ছদ্মরূপ ধারিণী গাভী নিজ দুগ্ধে পৃথিবীকে শস্যশ্যামলা করেন, এজন্য বিশ্বমাতা ও গোমাতা অভিন্ন। ঐ রূপ বিশ্বাস থেকে গরু দেবতারূপে পূজ্য হয়ে আসছে।)
দুই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধধর্মী ধর্মনীতির কারণে গো-হত্যা ও গো-রক্ষা নিয়ে সহজেই কলহ-বিবাদ বেধেছে। এ সমস্যাটি ভারতব্যাপী ছড়িয়ে ছিল।
>১৮৮২ সালে দয়ানন্দ সরস্বতী গো-হত্যা নিবারণী সভা’ স্থাপন করে গো-রক্ষা আন্দোলনের সূচনা করেন। সভার সদস্য ভ্ৰাম্যমাণ সাধুগণ বক্তৃতা, পত্রিকা, প্রচারপত্র, প্রাচীরপত্র প্রভৃতির সাহায্যে গো-রক্ষার আর্দশ প্রচার করতেন। এক সময় ভারতীয় কংগ্রেসকে এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়ান হয়।
>১৮৮৭ সালে মাদ্রাজের বার্ষিক অধিবেশনে রাজশাহীর তাহিরপুরের জমিদার শশিশেখর রায় গো-হত্যা বন্ধের একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
>১৮৯১ সালে নাগপুরের অধিবেশনে গো-রক্ষিণী সভার সদস্যগণ কংগ্রেসের প্যাণ্ডেলে সভা করার ও চাঁদা তোলার অনুমতি পান। (৩Muslim Community in Bengal, p 199)

>গো-রক্ষিণী সভার ফরিদপুর শাখার সম্পাদক যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ গো-হত্যা বন্ধ করার জন্য ‘কসাই-এর গো-হত্যা” শিরোনামে প্রচার পত্র বিলি করে জন মত তৈরি করে।হাটে-বাজারে মুসলমান কসাই-এর কাছে গরু বিক্রয় করতে নিষেধ করা হয়, ঐ সঙ্গে হিন্দু জমিদারদের নিজ নিজ জমিদারীতে গো-হত্যা বন্ধ করার আবেদন জানান হয়।

>ফরিদপুরের ‘আঞ্জুমানে ইসলাম মুসলমান সমাজের পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদ করে জেলা— প্রশাসকের কাছে আবেদন পত্র প্রেরণ করে। ঐ আবেদনপত্রে বলা হয় যে, গো-হত্যার প্রশ্নে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে নিত্য সংঘর্ষ বাধে ; বিহার ও উত্তর প্রদেশে এ নিয়ে দাঙ্গা হয়ে গেছে ; পূর্ববঙ্গে পূর্বে কোন বিবাদ ছিল না, কিন্তু যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষের প্রচারণার ফলে হিন্দুগণ গো-হত্যা বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর হয়। মুসলমানেরা এটি মেনে নিতে পারে না, ফলে শান্তি বিঘ্ন হওয়ার খুবই সম্ভাবনা আছে। জেলা-প্রশাসক যাতে ঐ রূপ প্রচারণা বন্ধ করার ব্যবস্থা নেন, ঐ পত্রে তার আবেদন জানান হয়েছে। The Moslein Chronicle, 4 April 1895, p. 138
গো-রক্ষিণী সভার পরেই জমিদারদের স্থান। অনেক জমিদার মুসলমান প্রজাদের ঈদ উপলক্ষে গো-কোরবানি অথবা বিবাহ উপলক্ষে গো-হত্যা নিষিদ্ধ করে দেন।
>মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ আত্মকথায় (আমার সংসার জীবন)" লিখেছেন, “গোবিন্দপুর,
হরিশঙ্করপুর, সনাতনী, গোপীনগর, আমলা, গোসাঞী পুকুর প্রভৃতি কতকগুলি গ্রাম একজন প্রচণ্ড প্রতাপান্বিত বড় হিন্দু-জমিদারের জমিদারীভুক্ত ; সেখানকার মুসলমানগণ বহুকাল অবধি গরু কোরবানি করিতে বা গরু জবে ও উহার মাংস ভক্ষণ করিতে পারিত না। কেহ করিলে তাহার আর রক্ষা ছিল না। জমিদার কাছারীর দুর্দান্ত হিন্দু নায়েবগণ কোরবানিদাতা ও গরু হত্যাকারীকে ধরিয়া আনিয়া প্ৰহার ও নানা প্রকার অপমান করিত এবং তাহাদের নিকট হইতে জরিমানা আদায় করিত। সুতরাং তাহাদের অত্যাচারে ঐ অঞ্চল হইতে গো-কোরবানী প্রথা উঠিয়া গিয়াছিল।”ইসলাম-প্রচারক, ৮ বর্ষ ৭ সংখ্যা, ১৩:১৪, পৃ: ২৭৫ 
তিনি আরও বলেছেন, হিন্দু প্ৰজাগণ এ ব্যাপারে জমিদারকে সমর্থন দিত। তিনি বলেন, সভা-সমিতির মাধ্যমে আন্দোলন চালিয়ে মুসলমানগণ পরিশেষে সাবধানতা ও গোপনীয়তা রক্ষা করে গরুকোরবানের সুবিধা পায়।
‘মোসলেম ক্রনিকলে 'একাধিক সংখ্যায় গো-হত্যা সমস্যার সংবাদ প্ৰকাশ করা হয়। ১৭ মার্চ ১৮৯৫ সালে লেখা হয়, রাজশাহী বিভাগের খোকসার অন্তর্ভুক্ত পানানগর ও অন্যান্য গ্রামের মুসলমানদের প্রতি গো-হত্যার জন্য দুর্ব্যবহার করা হয়। কমিশনারের রিপোটে ঐরুপ গো-হত্যা ও গোমাংস ভক্ষণে জমিদারের হস্তক্ষেপের উল্লেখ আছে। The Moslem Chronicle, 17 March 1895, p. 16
ময়মনসিংহের অস্বরিয়া, মুক্তাগাছা ও সন্তোষের জমিদারগণ কয়েকজন গ্রামবাসীকে গো-কোরবানির জন্য জরিমানা করেছিলেন। Ibid. 20 May 1895, p.235
>১৩১২ সনের ৫ জ্যৈষ্ঠ মিহির ও সুধাকর গরু জবাই শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করে। সংবাদে বলা হয় যে, চাঁদপুরের কতিপয় মুসলমান ঈদ উপলক্ষে গরু কোরবান দিলে গোপালচন্দ্র নামে এক ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে ফৌজাদারি নালিশ করেন। প্রকাশ্যে
রাস্তায় গরু জবাই করেছে এবং বদ্ধ জলে মাংস ধৌত করে জল অপবিত্র করেছে, তাদের বিরুদ্ধে এরূপ অভিযোগ আনা হয়। জেলা-হাকিম জগদীশচন্দ্র সেন সরজমিনে তদন্ত না করে একজনকে এক মাস কারাদণ্ড, একজনকে ৫০ টাকা ও অপরজনকে ১৫ টাকা অর্থদণ্ড করেন। Ibid, 16 May 1896, p. 224

সাহিত্যের ক্ষেত্রে গো-হত্যা সমস্যা সবচেয়ে গুরুত্ব পায় টাঙ্গাইলের ‘আহমদীতে (১ শ্রবণ ১২৯৫) প্রকাশিত মীর মশাররফ হোসেনের গোকুল নির্মূল আশঙ্কা’ প্রবন্ধকে কেন্দ্র করে। মশাররফ হোসেন  ছিলেন উদারপন্থী এবং হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে সমন্বয়বাদী। তিনি প্ৰবন্ধ লেখার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বলেন, “ভারতের অনেক স্থানে গো-বধ লইয়া বিশেষ আন্দোলন হইতেছে। সভাসমিতি বসিতেছে, বক্তৃতার স্রোত বহিতেছে, ইংরেজি, বাঙ্গালা সংবাদ পত্রিকায় হৃদয়গ্রাহী প্ৰবন্ধে সকল প্ৰকাশ হইতেছে, কোন কোন স্থানে হিন্দু মুসলমান একত্রে এক প্রাণে এক যোগে গোবিংশ রক্ষার উপায় উদ্ভাবন করিতেছেন। কোন কোন ইংরেজি পত্রিকায় আবার প্রতিবাদও চলিতেছে। এসময় আর নীরব থাকা উচিত মনে করিলাম না।”মশাররফ রচনা-সম্ভার, পৃ. ৩১৫

গো-হত্যা উভয়ের সম্পর্কে ফাটল ধরায় বলে তিনি মুসলমানদের গো-কোরবানি বন্ধ ও গো-মাংস ভক্ষণ ত্যাগ করতে বলেন। তিনি বলেছেন, “এই বঙ্গরাজ্যে হিন্দু-মুলসমান উভয় জাতিই প্রধান পরস্পর এমন ঘনিষ্ঠ সম্ববন্ধ যে, ধর্মে ভিন্ন, কিন্তু মর্মে এবং কর্মে এক — সংসার কাৰ্য্যে ভাই না বলিয়া আর থাকিতে পারি না। আপদে বিপদে সুখে দুঃখে, সম্পদে পরস্পরের সাহায্য ভিন্ন উদ্ধার নাই। সুখ নাই, শেষ নাই, রক্ষার উপায় নাই। এমন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ যাহাদের সঙ্গে, এমন চিরসঙ্গী যাহারা, তাহাদের মনে ব্যথা দিয়া লাভ কি?”মশাররফরচনা-সম্ভার, পৃ. ৩১৯
>টাঙ্গাইলের অপর পত্রিকা “আখবারে এসলামীয়া” মশাররফ হোসেনের বক্তব্যের প্রথম প্ৰতিবাদ করে ; পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন ছিলেন গোঁড়াপন্থী। তিনি ধর্ম সভায় বক্তৃতার ও পত্রিকায় লেখার মাধ্যমে মশাররফের প্রতিবাদ করে আন্দোলন গড়ে তোলেন। “আখবারে এসলামীয়ায় (শ্রাবণ ১২৯৫) প্রথম প্রতিবাদ হয় জনৈক ব্যক্তির প্রেরিত একটি পত্রে।( সম্পাদক মন্তব্য করেন, “আহমদীতে গােকুল নির্মূল সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ পড়িয়া নীরব থাকিতে পরিলাম না। আল্লা চাহে এ সম্বন্ধে পৃথকরূপে লিখিব, এবার এসলামীয়ার একটি প্রিয় বন্ধুর প্রেরিত প্ৰবন্ধটা প্ৰকাশ করিলাম।” — মশাররফ রচনা-সম্ভার, পৃ. ৩৩০—৪০)

পত্রে ২১টি পরিচ্ছেদে মশাররফের যুক্তি খণ্ডন করা হয়। পত্র শেষে উপদেশ দিয়ে বলা হয়, “সমাজের গ্রন্থি অতিশয় দৃঢ়, একটুক সাবধান হইয়া লিখনি ধরিবেন ; সমাজকে চটাইলে বড় প্ৰমাদ ঘটিবার সম্ভাবনা। উপসংহারকালে একটি হিতোপদেশ না দিয়া ক্ষান্ত থাকিতে পারিলাম না। আপনি তওবা করিয়া পুনরায় মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত হউন। তাহা না হইলে আপনার মুক্তিলাভের কোনই উপায় নাই।”(মশাররফ রচনা-সম্ভার, পৃ- ৩৪৯-৫০)
দ্বিতীয় প্রস্তাব ‘গোধন কি সামান্য ধন'-এ (শ্রাবণ ১২৯৫) মশাররফ হোসেন বলেন, “মোসলমান শাস্ত্রে গোজাতির গুণের ব্যাখ্যা নাই। — সুতরাং সাধারণ পশুর মধ্যে পরিগণিত। ... অত্রস্থ কোন মৌলবী মহামতির কথার আভাষে বুঝিয়াছি যে, ঐ কথা ভিন্ন আর তাঁহাদের কোন কথা নাই। ঐ কথাটুকু আশ্রয় করিয়াই গোধনের জীবন সংহার করিতে বাধ্য। ... কিন্তু ঐরোপ প্ৰতিবাদ, কি সভাসমিতির ভয়ে, এ অত্যাচার, অন্যায়াচার, হৃদয় বিদারক, মর্মাহত ভীষণ ব্যাপার স্বরূপ গো-হত্যা নিবারণ বিষয়, প্ৰস্তাব লিখিতে অধমের লিখনি ক্ষান্ত হইবে না।”(মশাররফ রচনা-সম্ভার,  পৃ. ৩২৮)


ক্রমশ--------------

বাংলা অক্ষরের বিবর্তন

$
0
0

বাংলা অক্ষরের বিবর্তন
গিনি

সব ভাষার অক্ষরের মত বাংলা অক্ষরও বিবর্তনের পর আজকের এই অবস্থায় এসেছে। পুরা যুগের বোদ্ধোরা শুরু করে লিপি বদ্ধের কাজ। হারপ্রসাদ প্রথমে তা ধারনা করেন ও দৃষ্টান্ত পান। তখন কার সেই রূপটি পরবর্তীতে আসামীয়রা আজকের এই বাংলা অক্ষরের কাছা কাছি রচনা করে আর সেটায় কিছুটা এদিক সেদিক হয়ে আজকের ক খ গ ইত্যাদি।

Viewing all 121 articles
Browse latest View live